১৬ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:০৭
লেখকের অন্য চোখ

এখান থেকেই শুরু ভৌতিক গল্পের

সমরেশ মজুমদার


এখান থেকেই শুরু ভৌতিক গল্পের

একটি ভ্রূণ মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। পৃথিবীর সব মানুষের জন্ম একইভাবে হয়ে থাকে। ওই জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত সময়সীমা কারও ক্ষেত্রে স্বল্প, কারও মাঝারি, কেউ দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন। ধরা যাক, পাঁচটি শিশু, যারা একই সঙ্গে পাঁচটি মাতৃগর্ভ থেকে নির্গত হয়েছিল। তাদের জন্মকাল থেকে একসঙ্গে রেখে, একই খাদ্য, ওষুধ, যত্ন দিয়ে বড় করে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত করা হলো। দেখা গেল এদের মেধা, পছন্দ এবং আগ্রহ একই রকম হচ্ছে না। যদি গোটা জীবন একসঙ্গে রাখা যায় তাহলে দেখা যাবে কেউ পঞ্চাশ, কেউ ষাট, কেউ আশিতে মারা গেল। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাত্ত্বিকরা বলবেন, পূর্বপুরুষের জিনের কল্যাণে এক-একজন এক এক রকম হয়েছে। যে শিশুর পিতা চিরকাল চাষ করেছে সে যদি দারুণ উপন্যাস লিখে ফেলে তাহলে তার পেছনে জিন কীভাবে কাজ করল তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। পাঁচজনের শরীর একই খাবার, এক ওষুধ খেয়েও বিভিন্ন সময়ে মারা গেল। কেন ওদের আয়ুর এই পার্থক্য হলো? ওদের তো কাছাকাছি সময়ে চলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। এসব প্রশ্নের উত্তর যাই হোক না কেন তা আমাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করে না। তাই বিভ্রান্ত হই। মাঝে মাঝে মনে হয়, একটি মানুষ সারা জীবন বেঁচে থেকে সবাইকে আনন্দ দিলেন, বিপদে পাশে দাঁড়ালেন, তার শরীরের মৃত্যুর পরে সবকিছু কেন শেষ হয়ে যাবে? শরীরের মৃত্যু তো একটা প্রক্রিয়া মাত্র, কিন্তু এই পৃথিবীর মাটি, বাতাসে যে মানুষটি দাপিয়ে বাস করেছেন সেখানে তার কোনো অস্তিত্ব মিশে থাকবে না? নরম মাটির ওপর কেউ হেঁটে গেলে তার পায়ের ছাপ সেই মাটিতে আঁকা হয়ে যায়। মানুষটি লক্ষ মাইল দূরে চলে গেলেও সেই ছাপ পড়েই থাকে। তাহলে যে হাসিখুশি পরোপকারী মানুষটি মারা গেলেন তার কোনো চিহ্ন পৃথিবীতে থাকবে না, তা মেনে নিতে খুব অসুবিধে হয়। 

আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি। একজন লেখক, কবি চলে গেলে তাদের বই থেকে যায়। একজন চিত্রশিল্পী ছবি রেখে যান। একজন গায়কের সিডি বা ক্যাসেট বহুকাল ধরে বেজে যায়। একজন চিত্রাভিনেতার ফিল্ম থাকে, একজন নাট্যশিল্পী বেঁচে থাকেন দর্শকদের স্মৃতিতে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তো এই সুযোগ নেই। তখন আমরা ভাবি তাদের আত্মাকে নিয়ে। ভেবে নিই সেই আত্মা মিশে আছেন আকাশে-বাতাসে। ব্যাপারটাকে ভৌতিক গল্প বলে নস্যাৎ করতে একদম ইচ্ছে করে না। অর্থাৎ শ্রাদ্ধ করার নামে আমরা আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিচ্ছি এবং সেই আত্মাকে দুষ্ট-আত্মা বলতেও দ্বিধা করছি না। বোধহয় এখান থেকেই ভৌতিক গল্পের শুরু। মৃত্যুর পরে নাকি অনেকেই মৃত মানুষটিকে দেখতে পান, অনুভব করেন। সেটা করতে তাদের ভালো লাগে বলেই করেন। একটি মানুষের মৃত্যু হওয়ামাত্র তার মন-হূদয় ইত্যাদির কি হাল হলো তা জানার কোনো উপায় নেই। তবু জাতিস্মরের কাহিনী আমরা বিশ্বাস করছি। 

সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’ লিখলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ভৌতিক গল্প। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর পরে আত্মাদের নিয়ে যে লেখা লিখলেন তা বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক হয়ে আছে। ‘দেবযান’ পড়তে পড়তে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, ওরা আত্মা নয়, জীবিত চরিত্র। মৃত শরীর থেকে বেরিয়ে উঠোনের গাছের ডালে বসে আত্মা অবাক হয়ে দেখছে তার শরীরকে কেন্দ্র করে কান্নাকাটি চলছে। প্রায় ৭০ বছর আগে লেখা এই কাহিনীর একাংশের প্রতিফলন দেখলাম ইংরেজি ‘ঘোস্ট’ ছবিতে, যা তৈরি হয়েছে বছর দশেক আগে। সেই ছবিতে আত্মা খুব বেচারা, ইচ্ছে করলেও একটা আলপিন নাড়াতে পারে না, স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধু প্রেম করতে চাইলে সে ঠাস করে চড় মারতে চায় কিন্তু বন্ধু টের পায় না। ছবিতে একটা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ এবং অসহায়তা থাকলেও ইউরোপ, আমেরিকায় একটি ভূতরাত্রি পালিত হয়। বাড়ির সামনে বিশাল কুমড়ো ঝুলিয়ে ভূত তাড়ানো হয়। অর্থাৎ এই অজানা জগৎ নিয়ে একটু মশগুল থাকতে পৃথিবীর সব মানুষই পছন্দ করে। 

কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে আত্মারা আসতেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত সন্তান শমীকে ভালোবাসতেন খুব, তাকে আনতে চাইতেন প্ল্যানচেটে। শোনা যায় সেসব আত্মা এসে পেন্সিলে কাগজের ওপর আঁকাবাঁকা অক্ষরে কিছু লিখে যান মিডিয়ামের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে মানুষের উদারতাও লক্ষণীয়। বেশ কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন, এমন আত্মাকে ডাকতে ডাকতে শেষ পর্যন্ত তিনি আসেন এবং লিখে যান, তিনি অনেক উচ্চস্তরে চলে গেছেন, সেখান থেকে আসতে খুব কষ্ট হয়, তাকে যেন আর কষ্ট দেওয়া না হয়। দেখে গেছে, কোনো প্ল্যানচেট-কর্মই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হতাশা প্রবল হয়, যখন কর্মটি অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয়।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ১৬ এপ্রিল, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর