৪ মে, ২০১৬ ১১:৫৮

মমতা বিদায় নিচ্ছেন আর জোট সরকার হচ্ছে, তাল ঠুকে বলতে পারি না

জয়ন্ত ঘোষাল

মমতা বিদায় নিচ্ছেন আর জোট সরকার হচ্ছে, তাল ঠুকে বলতে পারি না

৫ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার শেষ ভোট। এরপর এক দীর্ঘ বিরতি। ভোটের ফল প্রকাশিত হবে ১৯ মে। ১৬ মে বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। বুথ ফেরত ভোটসমীক্ষা ভোটের ফলাফল নয়। ব্যক্তিগতভাবে ভোট ফেরত সমীক্ষা নিয়ে আমারই মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে কেজরিওয়াল যে এ ভাবে ঝড় তুলবেন তা কোনও বুথ ফেরত সমীক্ষায় আঁচ করা যায়নি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি যে ক্ষমতায় আসবে না, উল্টে মনমোহন সিংহ ক্ষমতায় আসতে চলেছেন এটাও কোনও বুথ ফেরত সমীক্ষা বলতে পারেনি। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে এটুকু জানি, সার্ভে মেথডোলজি কত জটিল, কত কঠিন। ঠিক কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাচ গলে যায় সেটা পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু মানুষের অসন্তোষ ঠিক কতটা টগবগ করে ফুটলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় সেটার আগাম জরিপ করা সহজ কাজ নয়। কারণ এখানে গবেষণাগারটি সমাজ। আর গিনিপিগ হল মানুষ। যে মানুষের মনস্তত্ত্ব জটিল। সে সত্যি কথা নাও বলতে পারে। সত্য গোপন করতে জানে।

সে যাক সমীক্ষার কথা। মূল প্রশ্ন হল, কী হবে পশ্চিমবঙ্গে? লন্ডন থেকে বিবিসি'র সাংবাদিক বন্ধু জিজ্ঞাসা করছেন কেন এই কঠোর নীরবতা? কলকাতা থেকেও অনেকে জানতে চাইছেন যে আমার কী মনে হচ্ছে? এ বার ভোটের সময় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে আমি যাইনি। তাই আমার সমস্ত ইনপুট পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, তৃণমূলের সরকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষত, শহুরে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত-অভিজাত মানুষের অসন্তোষ পরিদৃশ্যমান। পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা সঙ্কটজনক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বেকারি যথেষ্ট। গত পাঁচ বছরে বহু ক্ষেত্রে টাকা রোজগারের বিবিধ পথ বেকার যুবকদের কাছে উন্মোচিত হলেও, যাকে বলে হোয়াইট কলার জব, তার সম্ভাবনা কিন্তু সে ভাবে বাড়েনি। রাজ্যে ভারী শিল্প বা উৎপাদনমুখী শিল্প না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ যে আসবে না সে কথাও বোঝার জন্য অর্থনীতির পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই।

এই অসন্তোষকে মূলধন করে সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনের বিরুদ্ধে ফের বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করেছে। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন দলটার কোমর ভেঙে গিয়েছে। পাল্টা মার দেওয়া তো দূরের কথা, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না। এই অবস্থায় মতাদর্শগত পার্থক্য এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে সিপিএম নির্বাচনী সমঝোতা করে ফেলেছে কংগ্রেসের সঙ্গে। এটা কৌশলগত দিক থেকে সিপিএমের একটা বড় সাফল্য। মমতা নিজেও সিপিএমের আগেই কংগ্রেসের সঙ্গে একটা নির্বাচনী গাঁটছড়া বেঁধে ফেলতে পারতেন। সে সুযোগ যে ছিল না তাও নয়। নীতীশ কুমারের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানের দিন রাহুল গাঁধীর সঙ্গে তাঁর আলোচনাকে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। হয়তো আসন ছাড়ার ক্ষেত্রে তাঁকে সদয় হতে হত।
সিপিএম এবং কংগ্রেস যৌথ ভাবে গত দু’মাস ধরে প্রচারাভিযানকেও মমতা সরকারের বিরুদ্ধে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। ফেসবুক, টুইট, সোশ্যাল মিডিয়াতেও এক চূড়ান্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে যে ভাবে তীব্র তৃণমূল বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, কিছু দিন পর তাতে পরিবর্তন আসে। অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ মনে করতে শুরু করেন, পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু তাঁদের কাছে অগ্রাধিকার রাজ্য নয়, সে হেতু ওখানে অত শক্তির অপব্যয় না করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের উন্নতি করাটাই বিচক্ষণতার পরিচয়। কিন্তু জোট গঠনের পর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপর রাজ্য নেতৃত্বের চাপ আরও বেড়ে যায়। নরেন্দ্র মোদি বাধ্য হন আবার আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ দলীয় নেতাদের বোঝান, রাজ্যে জোট যদি ক্ষমতায় আসে তাতেও বিজেপির লোকসান নেই। বিজেপি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে আগামী দিনের জন্য এগোবে। পরবর্তী বিধানসভায় বিজেপির স্লোগান হবে, সকলেই পরীক্ষিত। এ বার বিজেপিকে সুযোগ দিন।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত ভোটের সময়ে বিরোধীরা অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন শাসকদের হয়ে কাজ করছে। এ বার ভোটে তা-ও হয়নি। উল্টে শাসক দলের এজেন্টরাই বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রহৃত হয়েছেন। অতএব ভোটের ফলাফল যাই হোক, ভোটে রিগিং হয়েছে অথবা ভূতেরা ভোট দিয়েছে— এই অভিযোগ উঠছে না।

এত কিছুর পরেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বিদায় নিচ্ছে আর জোটের সরকার গঠন হচ্ছে, এ কথা তাল ঠুকে বলতে পারি না। এক প্রবীণ সাংবাদিক বলছিলেন, অটলবিহারী বাজপেয়ী চলে গিয়ে মনমোহন সিংহ আসবেন এটাও তো ভাবা যায়নি। আর দিল্লিতে কেজরীবাল মুখ্যমন্ত্রী হবেন এমনটাই বা ক’জন ভেবেছিলেন! তবু সাংবাদিক হিসাবে কয়েকটা হিংটিংছট প্রশ্ন মাথার মধ্যে কামড়াচ্ছে। 

প্রথমত: শহর এবং গ্রামের ভোটার আচরণে এখনও অনেক ফারাক আছে। জঙ্গলমহলের এক জন গ্রামবাসীর কাছে দু’টাকা কিলো চাল আর বাড়ির সামনে রাস্তা এখনও নারদ ইস্যুর চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। 

দ্বিতীয়ত: ভারতের নির্বাচনগুলিতে দুর্নীতি কিন্তু অনেক সময়েই ভোটের নির্ধারক বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের একটি অংশে সংবেদনশীলতা যা রয়েছে তা সমগ্র অংশে নেই। 

তৃতীয়ত: সংবাদ মাধ্যমের অনেক সময় প্রচারসংখ্যা বা টিআরপি থাকলেও, গ্রামীণ জনসমাজের উপরে তার প্রভাব ততটা থাকে না। 

চতুর্থত: শহরের ইস্যু অনেক সময় গ্রামে প্রচারের ইস্যু হতে সময় লেগে যায়। এ আর দেশাইয়ের গ্রামীণ সমাজতত্ত্ব বইয়ে বলা হয়েছে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ গ্রাম ও শহরের অভিস্রবণ অনেক কম।

জোট যদি ক্ষমতায় আসে তা হলেও পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যতের পথচলা মসৃণ হবে বলে মনে হয় না। কেননা দু’দলের এক জোট ক্ষমতায় আসা এক জিনিস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো জটিল সমস্যাসঙ্কুল রাজ্যে সমস্যার সমাধান এই বৈপরীত্যের ঐক্য কতটা করতে পারে তা একটি বড় প্রশ্ন। আবার মমতা যদি ফের ক্ষমতায় আসেন তা হলেও দ্বিতীয় তৃণমূল সরকারের পথ চলাও কিন্তু হবে কণ্টকাকীর্ণ। গত পাঁচ বছরে যে সব কারণে সরকারের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়েছে, তাতে সোনালি গুহের আচরণ হোক, নারদ কেলেঙ্কারি হোক, সিন্ডিকেট ও পেশীশক্তির আস্ফালনই হোক— এ সব থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসাও হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সিপিএম উন্নততর বামফ্রন্টের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছিল, শিক্ষা থেকে আইনশৃঙ্খলা— সব ক্ষেত্রেই লুম্পেনবাহিনীর হাতেই ছিল নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যদি দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার গঠনের সুযোগ পান, আর তখন যদি জোট হয় এক প্রবল পরাক্রান্ত বিরোধী শক্তি, তখন তৃণমূলের রাজনৈতিক ডিএনএ-তে কোনও পরিবর্তন আসবে?

এর আগেও লিখেছিলাম, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ বইটির কথা। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরের গ্লানি বহনকারী বাঙালি আমরা। রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য যাই হোক, ক্ষমতার রদবদল যাই হোক, এই দারিদ্র্যপীড়িত বাংলার চনমনে একটি ভবিষ্যৎ ভাবাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


বিডি-প্রতিদিন/ ০৪ মে, ২০১৬/ আফরোজ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর