২৯ মে, ২০১৬ ১৯:২৩

হুমায়ূনকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখছেন গুলতেকিন

দর্পণ কবির, নিউইয়র্ক থেকে

হুমায়ূনকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখছেন গুলতেকিন

গুলতেকিন খান ও দর্পণ কবির

গুলতেকিন খান। নামেই তাঁর পরিচয়। তিনি চান, কিংবা না চান-পরিচয়টা এক বিশাল জনপ্রিয়তার বৃত্তে কেন্দ্রবিন্দুর মত যেমনি অবিচ্ছেদ্য, তেমনি এর অভিব্যক্তি করোজ্জ্বল। এটা সৃষ্টি হয়েছে প্রথমত তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাসিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী বলে, দ্বিতীয়ত তিনি নিজেকে নিজের মত করে আড়াল করে রাখতে পেরেছেন বলে। ফলে তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে সকলের মধ্যে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়ে আছে। তাঁকে বলতে হয় অন্যরকম এক ব্যক্তিত্বের ধ্রুবতারা। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ কথাটা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। এই গুলতেকিন খান যেন ঝিনুকের খোলস ছেড়ে বের হয়ে এলেন কবিতার মুক্তো ছড়িয়ে। গত বছর একুশের বইমেলায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আজো কেউ হাঁটে অবিরাম' প্রকাশিত হয়। অনেক দিন ধরে বন্ধ এক লৌহ কপাট যেন খুলে গেল এবং বেরিয়ে এলো এক পশলা কোমল আলো। 

সে যাই হোক, নিউইয়র্কে গত ২২ মে জ্যাকসন হাইটসে জামাল আবদীন খোকার বাড়িতে (তাঁর আত্মীয়) মুখোমুখি হলাম কবি গুলতেকিন আহমেদের। সাক্ষাৎকার গ্রহণের শুরুতেই জানালেন, কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না। ইঙ্গিত করলেন যেন হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে কথা না বলি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হুমায়ুুন আহমেদের প্রথম স্ত্রী বলেই তো আপনার একটা জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। এই জনপ্রিয়তাকে উপভোগ করেন না? অথবা এই জনপ্রিয়তাকে কীভাবে দেখেন? এর জবাবে তিনি বললেন, এমন জনপ্রিয়তা আমি উপভোগ করি না। সব সময় উপেক্ষা করেছি। নিজেকে আড়াল করে রাখতেই সচেষ্ট ছিলাম। যখন হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী ছিলাম, তখনও আমি তাঁর (হুমায়ুন আহমেদের) স্ত্রী বলে পরিচয় দিইনি। তাঁর জনপ্রিয়তার সুযোগ কখনও নিইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বা পরবর্তীতে নিজের কর্মস্থলে (স্কলাসটিকা স্কুলে) যতদিন পেরেছি নিজের স্বামীর পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা করেছি। একটা সময় তা পেরে ওঠা যায়নি। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, আসলে আমি সব সময় নিজের দাদা প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’র নাতনী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতাম। এখনও নিজের এই পরিচয়টা দিতে পছন্দ করি। একজন জনপ্রিয় লেখকের স্ত্রী ছিলাম, এই পরিচয়টা আমাকে কখনও উৎসাহিত করেনি। সাক্ষাৎকারের শেষ সময়ে দুটি প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। এই প্রশ্ন দুটির জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। প্রশ্ন ছিল, হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর আগে (অসুস্থ থাকার সময়ে) আপনি কি তাঁর সঙ্গে করার চেষ্টা করেছিলেন? তিনি জানান, চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদকে যেন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করাটা ছিল দুরূহ কাজ। তিনি বলেন, মাঝেমাঝে আমাদের কথা হতো। কারণ, হুমায়ুন আহমেদ আমার সন্তানদের পিতা ছিলেন। এ কারণেই কথা হতো। তবে সবসময় একটা দেয়াল যেন ছিল তাঁর চারপাশে। এ প্রসঙ্গে আর বেশি কিছু কথা বলেননি তিনি। 

আরেকটি প্রশ্ন ছিল, হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে আপনি কোন স্মৃতিকথা লিখবেন কিনা? জবাবে তিনি বলেন, আমি হুমায়ুনকে নিয়ে স্মৃতিকথামূলক একটি বই লিখছি। প্রায় অর্ধেক লিখে ফেলেছি। লেখার কাজ শেষ হলেই তা বই আকারে বের হবে। এ কথা ছিল সাক্ষাৎকারের শেষ প্রশ্নের জবাব। এর আগে নানা কথা হয়েছে। এরমধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, আপনার অসীম ধৈর্য শক্তি ও নীরব থাকার একটা অদ্ভুত শক্তিও আছে, এটা পেয়েছেন কার কাছ থেকে? জবাবে গুলতেকিন খান (স্মিত হেসে) বলেন, এটা সঠিক করে কিছু বলতে পারবো না। হয়তো আমার চরিত্র এটি। তবে সবসময়ই দাদু (প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ) ছিলেন আমার আদর্শ। আমার দাদীর মৃত্যুর পর দেখেছি দাদু চুপচাপ থাকতেন। তিনি দাদীকে ভীষণ ভালবাসতেন। হয়তো দাদুর কাছ থেকে পেয়েছি। বংশগত স্বভাব বলা যায়। তাছাড়া আমার ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবসময়ই ছিলাম চুপচাপ। কথা বলতাম না একেবারে। ইদানিং তো অনেক কথা বলছি।

গুলতেকিন খানের কাছে প্রশ্ন ছিল, কবি হলেন কীভাবে? তিনি বলেছেন, ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় থেকে ছড়া লিখতাম। বিয়ের পর লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে সংসারী হয়ে যাই। ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি ছড়া লিখতাম। তবে আমার ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। ডায়েরি লেখা বিষণ্নতা নিরসনের ভাল থেরাপি। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে ছোটবেলার ছড়ার খাতাটা হঠাৎ খুঁজে পাই। তখন লেখালেখির বিষয়টা পুনরায় মাথায় আসে। তবে সত্যজিৎ রায়ের মত ছড়াকার হতে পারব না ভেবে ছড়া লেখার দিকে না ঝুঁকে কবিতা লেখার চেষ্টা করি। একটা সময় কবিতার বইও পড়তাম। ২০১৩ সাল থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি। কবিতা বন্ধুদের শোনাই, ফেসবুকে পোস্ট করি। এতে ব্যাপক সাড়া পাই। আড়াই বছর পর দেখি ৩৫টি কবিতা হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, নিজের ভাল লাগার জন্য আমি কবিতা লিখি। কবির স্বীকৃতি পাবো বা কিছু পাবো, এই ভাবনা আমার নেই। আত্মতৃপ্তির জন্য কবিতা লিখি। গত বছর তাম্রলিপি প্রকাশনী আমার কবিতার বইটি প্রকাশ করে। বইটির বিক্রিও ভাল হয়েছে। এটি ছিল জাফর ইকবালের বইয়ের পর দ্বিতীয় বেস্ট সেলার বই। 

কাউকে ভেবে বা কারো জন্য আনন্দ বা কষ্ট পেয়ে কোন কবিতা লিখেছেন কি? এর জবাবে তিনি বলেন, কাউকে ভেবে কবিতা লিখিনি। তবে বনানীতে একবার ১১ বছরের একটি শিশু ক্রিকেট খেলার সময় মাথায় বলের আঘাত পেয়ে মারা গিয়েছিল। তাকে উদ্দেশ্যে করে একটি কবিতা লিখি। এ ছাড়া আমার ছোট মেয়ে যখন পুত্র সন্তানের মা হয়, তখন আমি ওই আনন্দে একটি কবিতা লিখেছিলাম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে কবিতার পাঠক খুব কম। তিনি আরো জানান, নিজেকে কবি ভাবেন না। কবি ভাবার স্পর্ধা তাঁর নেই। কবিতার বইয়ের নাম 'আজো কেউ হাঁটে অবিরাম' কেন রেখেছেন? এর জবাবে বলেন, আসলে আমি বইটির নাম রেখেছিলাম, 'দিকভ্রান্ত জলপরী'। নামটি শোনার পর আমার বড় মেয়ে নোভা বলল, মা, তোমাকে সবসময় দেখেছি বিভ্রান্ত না হয়ে, ভেঙে না পড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজে পথ চলেছো। এই নামটি নিয়ে পাঠকদের মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে। ওর কথাটা ভাল লাগে। পরে নাম রাখি 'আজো কেউ হাঁটে অবিরাম'। ছোটবেলায় তিনি কী হতে চেয়েছিলেন প্রশ্নের জবাবে জানান, তাঁর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন। হতে পারেননি। হয়েছেন শিক্ষক। ছেলে নুহাশ কী হতে চায়? এই প্রশ্নে জানিয়েছেন, নুহাশ চলচ্চিত্র বানাতে চায়। নুহাশের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং ছেলের পাশে থাকছেন। তাঁর কথা, সন্তানরা যাই করতে চায়, করুক। তাদের স্বাধীনতায় কোন হস্তক্ষেপ করতে চান না।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৯ মে, ২০১৬/ আফরোজ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর