১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ১৩:২০

যে কারণে পদ্মাসেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়ে গেল

শওগাত আলী সাগর :

যে কারণে পদ্মাসেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়ে গেল

শওগাত আলী সাগর

অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের নথিপত্র জব্দ করার প্রক্রিয়ার আইনি ভিত্তির প্রশ্নেই বিচার শুরুর আগেই বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলাটি বাতিল হয়ে গেছে।

ব্যক্তিগত যোগাযোগের নথিপত্র জব্দ করার যথেষ্ট ভিত্তি না থাকা এবং অহেতুক তথ্যানুসন্ধান থেকে মুক্ত থাকার নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন আদালত  মামলায় উপস্থাপিত প্রমানাদি বিচার প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত ৬ জানুয়ারি বিচারক জে নর্ডেইমার এই সিদ্ধান্ত দেন।

অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের আদালতে থাকা এই মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এই  তথ্য পাওয়া গেছে।

পরে গত ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার বিচারের নির্ধারিত দিনে তিনজন অভিযুক্ত নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। প্রসিকিউশন তাদের কাছে জমা দেওয়া সাক্ষ্য প্রমানের বাইরে নতুন কোনো সাক্ষ্য বা প্রমান নেই জানালে তাদের নির্দোষ ঘোষনা করে মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়।

আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, কতিথ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বিষয়ে মামলাটির কার্যক্রম চলার এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের একটি মামলার রায়ের উদাহরণ তুলে ধরে কানাডা পুলিশ কর্তৃক তাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্যাদি জব্দ করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ৬ জানুয়ারি রুলিংটি দেন। রুলিং দেওয়ার পর এটিকে ‘প্রকাশনা নিষিদ্ধের আওতায় রাখা হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

বিচারক জে নর্ডেইমার তার রুলিং এর উপসংহারে বলেন, ২০১১ সালে ২৪ মে, ১১ জুন এবং ৮ আগষ্ট আদালত অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের নতিপত্র জব্দ করার যে অনুমোদন দিয়েছিলেন তাতে আইনি ভিত্তির ঘাটতি আছে। আর এই অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক তথ্যানুসন্ধান থেকে মুক্ত থাকার চার্টার অব রাইটস এর ৮ অনুচ্ছেদে দেওয়া অধিকার লংঘন করা করা হয়েছে। এই কারনে অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত যোগযোগের নথিপত্রকে এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হলো।

বিশ্বব্যাংকের তদন্ত সম্পর্কে আদালতের বক্তব্য:

আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্সি অব ইনটিগ্রিটি অফিসের কর্মকর্তা পল হেইন্স আরসিএমপিকে পদ্মাসেতু সংক্রান্ত তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন।  তিনি জানান, চারজন গোপনসূত্র ইমেইলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংককে পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে। এক নম্বর এব তিন নম্বর তথ্যদাতাকে হেইন্স চেনেন না কিংবা তাদের সাথে তার দেখা সাক্ষাত হয়নি।  দুই নম্বর তথ্যদাতার পরিচয় হেইন্স জানতেন। তবে তার অনুরোধে হেইন্স আরসিএমপির কাছে তার পরিচয় প্রকাশ করেননি। চার নম্বর তথ্যদাতাকে হেইন্স চিনতেন এবং তার পরিচয় তিনি আরসিএমপিকে দিয়েছেন। কিন্তু তার দেওয়া তথ্যগুলো ছিলো নিতান্তই সরলীকৃত- ‘এসএনসি লাভালিন দুর্নীতিতে জড়িত’ জাতীয় বক্তব্য।

আদালত বলেছেন, এই তথ্যদাতাদের কেউই এর আগে বিশ্বব্যাংক বা পুলিশকে কোনো তথ্য দেয়নি। তদন্তকালে আরসিএমপি এক নম্বর বা তিন নম্বর তথ্যদাতার সঙ্গে একবারও কথা বলেনি। আরসিএমপির একজন কর্মকর্তাও দুই নম্বর তথ্যদাতার সাথে দেখা করেননি। একজন কর্মকর্তা তার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের নথি জব্দ করার অনুমতির জন্য আদালতে যে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছে তাতে এই চার তথ্যদাতার দেওয়া তথ্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- তথ্যদাতারা অন্য সূত্র থেকে এইসব খবর পেয়েছে।

আদালত বলেছে, তথ্যদাতারা যেসব সূত্র থেকে খবর নিয়ে বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে- পুলিশ তাদের কারো সাথেই যোগাযোগ করেনি। তথ্যদাতারা অবশ্য তাদের খবরের সূত্রদের অনেকেরই নাম পরিচয় পুলিশ এবং বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে।

আদালত বলেছে, এক নম্বর তথ্যদাতা বিশ্বব্যাংককে অনেকগুলো ইমেইল পাঠিয়েছে। এইসব ইমেইলের কোনো কোনোটিতে এটাচমেন্ট হিসেবেও  কিছু  নথিপত্র পাঠানো  হয়েছে। এদেরই  একটি নথি ‘অভিযোগ’। এই নথিটি কে তৈরি করেছে তা পরিষ্কার নয়। এই নথিতে উল্লেখ করা তথ্য বিশ্বাসযোগ্য কী না তাও  স্থির করার কোনো উপায় নাই। বিশ্বব্যাংক এক নম্বর তথ্যদাতার ইমেইলের জবাবে ফিরতি কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছে। কিন্তু সেই সব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এক নম্বর তথ্যদাতা ‘বিশ্বব্যাংক খোঁজ নিতে পারে, বিশ্বব্যাংকের সর্বত্র প্রবেশাধিকার আছে’ জাতীয় বক্তব্য দিয়েছে।

আদালত বলছেন, এক নম্বর তথ্যদাতা পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে তথ্য দিয়েছেন তা মূলত ‘গুজবের’ উপর ভিত্তি করে। একটি দলিলের  উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত বলছেন, ওই দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে.”বাছাই করা পাঁচটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতির গুজবের কথা আমরা শুনেছি। সাম্প্রতিক গুজবটি মনে হচ্ছে তথ্যভিত্তিক। তবে সেটি এখনো আমি দেখিনি। এই গুজব যদি সত্য হয়, তা হলে বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ করা বিশেষ  কমিটি যথাযথভাবে প্রস্তাব মূল্যায়ন করেনি।“

আদালত বলছেন, এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দুর্নীতির অভিযোগটি গুজবের উপর ভিত্তি করে, কেউ দেখেনি এমন একটি তথ্যের ভিত্তিতে, যা যিনি বলছেন তিনিও সত্য বলে মনে করছেন না। আর যিনি অভিযোগটি করছেন, তিনিও অজানা।

আদালত বলেছেন, এক নম্বর তথ্যদাতা কোনো ইমেইলে কিছু ব্যক্তির নাম ঠিকানা দিয়ে বলেছে, তাদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানা যাবে। বিশ্বব্যাংক তাদের কারো সঙ্গে যে যোগাযোগ করেছে, তার কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি।

লেখক : প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক, নতুনদেশ ডট কম।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর