মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইউরোসেরা পর্তুগাল

রাশেদুর রহমান

ইউরোসেরা পর্তুগাল

অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো টিকে রইলেন মাঠে। গড়িয়ে পড়া অশ্রু কণাগুলোকে উপেক্ষা করে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চললেন বিজয়ের পথে! কিন্তু এ যন্ত্রণা কী সহ্য করার মতো! স্ট্যাড দ্য ফ্রান্সে ইউরো কাপের ফাইনাল ম্যাচের ২৫তম মিনিটে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। কত হেকিম এলো বৈদ্য এলো রোনালদো আর উঠলেন না। স্ট্রেচার ডেকে পাঠালেন রেফারি। আহত রোনালদো মাঠ ছাড়লেন অশ্রুতে মুখ ঢেকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই কান্নার রোল পড়ল পর্তুগিজ শিবিরে। স্ট্যাড দ্য ফ্রান্সের গ্যালারি কিংবা আইফেল টাওয়ারের নিচে ‘ফ্যান জোন’ সবখানেই পর্তুগিজদের হাহাকার। ঠিক এর বিপরীতে ফরাসিরা বুনো উল্লাসে মেতে উঠল। লাল-নীল-সাদা রঙের সমুদ্র ফুলে ফেঁপে উঠল। তুমুল গর্জনে কেঁপে উঠল চারদিক। এ যেন ইউরো জয়ের উৎসবে মেতে ওঠার পূর্ব ঘোষণা!

কিন্তু হায়! রোনালদো যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। যার সঙ্গে বিদায় হলো ফরাসি ছন্দও! যে ফরাসিরা ম্যাচের শুরু থেকেই আগ্রাসী। রোনালদোকে রুখে দেওয়ার আঁটসাঁট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। ইউরো কাপের তৃতীয় শিরোপা বগলদাবা করার দৃপ্ত শপথের বলে বলিয়ান। সেই ফরাসিরাই রোনালদোর বিদায়ে ছন্দ হারাল। এই ছন্দ আর ওরকম করে পুরো ম্যাচেই দেখা যায়নি। বরং রোনালদোর পরিবর্তে মাঠে নামা কোয়ারেসমা গতি বদলে দিলেন। বল পজেশনে পর্তুগিজরাও আধিপত্য দেখাতে শুরু করল। ফরাসিদের ব্যরিয়ারগুলোতে ভাঙন ধরল। রোনালদো মাঠ ছাড়ার পর ফরাসিদের ‘গেম প্ল্যান’ গোলমেলে হয়ে গেল। আর পর্তুগিজরা সুবিধা পেতে শুরু করল এতেই। তবে দ্বিতীয়ার্ধে ‘গেম প্ল্যান’ বদলে মাঠে নেমে ফরাসিরা আবারও চেপে ধরেছিল পর্তুগালকে। কিন্তু বল পজেশনে আর একক আধিপত্য দেখাতে পারেনি ফ্রান্স। তারপরও স্বাগতিকরাই ম্যাচটা জিতছে বলে ধরে নিয়েছিল প্রায় সবাই। রোনালদো যেমন ইউরো কাপের শিরোপা হাতে নেওয়ার পর আফসোসের সুরে বললেন, ‘আমাদের ওপর কেউই বিশ্বাস রাখেনি।’ সত্যিই তো! একমাত্র রোনালদোর কারণেই পর্তুগালকে ফেবারিটের তালিকায় সর্বনিম্নে স্থান দিয়েছিলেন ফুটবলবোদ্ধারা। সেই রোনালদোকে ছাড়া যে পর্তুগাল ইউরো কাপ জিতবে, এ তো কোনো কল্পনাবিলাসীও ভেবে দেখেনি। নির্ধারিত ৯০ মিনিট পেরিয়ে অতিরিক্ত মিনিটে যাওয়ার পর ম্যাচটা ঝুলে পড়ে দুই দিকেই। তবে এডার ১০৯ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে বুলেট গতির শটে গোল করে পর্তুগালের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন যা ফিগোদের মতো কিংবদন্তিরাও পারেননি। এই একটা গোলই পর্তুগালকে এনে দেয় ১-০ ব্যবধানের জয়। ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। ফুটবলের এলিট শ্রেণিতে এবার পর্তুগালের নামও লেখা হলো।

ইউরো কাপে ২০০৪ সালে ফুটবলভক্তরা দেখেছিল নতুন চ্যাম্পিয়ন। সেবার এই পর্তুগালকে হারিয়েই শিরোপা জিতেছিল ‘আন্ডারডগ’ গ্রিস। এবার পর্তুগালও ছিল আন্ডারডগ। অন্তত ফরাসিদের তুলনায় তো বটেই। ১২ বছর পর ইউরো কাপের ফাইনালে উঠে এবার আর হতাশ হতে হলো না রোনালদোদের। এ জয়ের মধ্য দিয়ে ফরাসিদের বিপক্ষে মোক্ষম প্রতিশোধও নিয়ে নিল পর্তুগিজরা। ২০০৬ সালের সেমিফাইনালে এই ফ্রান্সের কাছেই তো হেরেছিল পর্তুগাল। তাছাড়া গত ৩৮ বছর ধরে ফ্রান্স গেরোতে আটকে ছিল পর্তুগাল। সেই গেরোটা খুললেন রোনালদোরা। পর্তুগিজ রাষ্ট্রনেতার অনুরোধ রাখলেন রোনালদো। ইউরো যাত্রার আগে রোনালদোদের কাছে ইউরো কাপের শিরোপা দাবি করেছিলেন পর্তুগিজ রাষ্ট্রপ্রধান। ইউরো কাপের শিরোপাটা রোনালদোরা উৎসর্গ করলেন ভক্তদের। পর্তুগিজ অধিনায়ক বলেন, ‘এই ট্রফিটা সব পর্তুগিজের জন্য এবং যারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন তাদের জন্য।’ রোনালদোদের এমন উৎসবে শামিল লুই ফিগোও। তিনি লিখেছেন, ‘চ্যাম্পিয়ন! দি গ্রেটেস্ট!। অভিনন্দন!’

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের চারদিকে উৎসবের রঙ। লাল-নীল পতাকার ছড়াছড়ি। পর্তুগিজরা নাকি এমনই উৎসবমুখর। সামান্য কিছুতেই মেতে উঠে প্রাণের উৎসবে। আর এ তো উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের চকচকে ট্রফি জয়ের অসাধারণ এক গল্পগাঁথা! অতীতে এমন রূপকথা আর কবে দেখেছে পর্তুগিজরা! রোনালদোদের ফিরে আসার মুহূর্তটা স্মরণীয় করেই রাখল ওরা। বাদ্য বাজিয়ে, ছবি তুলে, গান গেয়ে আর নেচে লিসবনকে রাঙিয়ে দিল ফুটবলভক্তরা। পর্তুগিজদের এ উৎসবের ঠিক বিপরীত চিত্র ফ্রান্স জুড়ে। অথচ উৎসবের প্রস্তুতিটা ছিল ফরাসিদেরই। এখন সবখানেই মেলা ভাঙার চিহ্ন। মেতে উঠা মন বিষণ্ন হয়ে আছে। আর পত্রিকাগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে অনেকটা শোক প্রকাশের ভঙ্গিতে। এই যেমন লা প্যারিসিয়ান পত্রিকা সংবাদ লিখল ‘সো ক্রুয়েল’ শিরোনামে। ফ্রান্সজুড়ে এখন শোকের মাতম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর