শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভুলতে পারিনি সেই দৃশ্য

ভুলতে পারিনি সেই দৃশ্য

অমলেশ সেন

বাংলাদেশের ফুটবলে উজ্জ্বল নক্ষত্র অমলেশ সেন। মধ্যমাঠে তার মতো মানসম্পন্ন খেলোয়াড় এখনো চোখে পড়েনি। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান ছেড়ে তিনি ১৯৭২ সালে নবাগত আবাহনী ক্রীড়াচক্রে যোগ দেন। এরপর আর অমলেশ দল ছাড়েননি। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেলে গেছেন আবাহনীতে। ১৯৭৬ সালে তিনি দলের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালকে। তার আবাহনীতে যোগ  দেওয়া ও শেখ কামালকে নিয়ে স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে—

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অমলেশ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে ভারতে প্রীতি ম্যাচে অংশ নেন। অন্যসব ফুটবলার দেশে ফিরে এলেও মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি কলকাতায় থেকে যান। সেখানেই তাকে আবাহনীতে খেলার অফার দেন তানভীর মাজহারুল  ইসলাম তান্না। তান্না ছিলেন স্বাধীন বাংলা দলের ম্যানেজার। আবাহনী দল গড়ার পেছনে তারও ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। অমলেশ বললেন, শেখ কামালের সঙ্গে তান্না ও কাজী সালাউদ্দিনের বন্ধুত্ব ছিল আগে থেকেই। ১৯৭২ সালে লিগ মাঠে গড়ানোর আগে তান্না কলকাতায় এসে হাজির। বললেন, শেখ কামালের দল আবাহনীতে খেলতে হবে। প্রথম অবস্থায় তার অফারে সাড়া দিইনি। কারণ নতুন নতুন দলে কারা কারা খেলবে তা আমার জানা ছিল না। আমি তখন খেলতাম দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল মোহামেডানে। সে কারণে এখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ঢাকায় এসে দেখলাম আমাকে রাখার ব্যাপারে মোহামেডানের কেউ কথা বলছেন না। তা ছাড়া গোলাম সারওয়ার টিপু, সালাউদ্দিন ও আশরাফ আবাহনীতে যোগ দেওয়া নিশ্চিত করেছে। আমিও চলে এলাম নতুন দল আবাহনীতে।

আবাহনীতে আসার পরই কি শেখ কামালের সঙ্গে পরিচয়? অমলেশ জানালেন, চিনতাম আগে থেকেই। তিনি বাস্কেটবল ও ক্রিকেট খেলতেন, ফুটবলে ছিলেন নিয়মিত দর্শক। ১৯৭১ সালে ভারতে প্রায়ই স্বাধীন বাংলা ক্যাম্পে আসতেন। দেশ নিয়ে আলোচনা করতেন। আবাহনীতে আসার পর আন্তরিকতা বেড়ে যায়। খেলাপাগল মানুষ ছিলেন। খেলার দিন ছাড়াও আবাহনীর অনুশীলনে নিয়মিত থাকতেন। খেলা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। খেলাধুলার মান কীভাবে বাড়ানো যায় এ চিন্তাটা সার্বক্ষণিক করতেন। বিশেষ করে ফুটবলকে ঘিরে আলাদা স্বপ্ন দেখতেন।

কীভাবে শেখ কামালের মৃত্যুর সংবাদটি পেলেন? এ প্রশ্ন করতেই অমলেশের চোখ ছল ছল হয়ে উঠল। বললেন, আমরা তখন মালয়েশিয়ায়। মারদেকাকাপ খেলতে গেছি। ১৬ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। সেদিন সকালে অনুশীলন করতে আমরা হোটেল ছাড়ছি। তখনই হোটেলের এক কর্মচারী সামনে এসে হাজির। ভাবলাম টুর্নামেন্ট প্রসঙ্গে কথা বলতে এসেছে। কিন্তু বেশ গম্ভীরভাবে বলে উঠলেন, তোমরা কি খবরটা জান না। আমাদের ভিতর কে যেন বলে উঠল কীসের খবর? কেন, তোমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের গোটা পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। কথাটা আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কেউ কেউ আবার বলল, দূর ও ভুল শুনেছে। অনুশীলন বাদ দিয়ে হোটেলে টিভি অন করলাম। দেখলাম এ নির্মম ঘটনাটা সত্য। দেশের বাইরে থাকা দুই কন্যা ছাড়া ঢাকায় নিজ বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নেই, কামাল ভাই নেই, এ ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজেদের আর ঠিক রাখতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রতিবাদ হিসেবে ম্যাচ বয়কট করব। কিন্তু টুর্নামেন্ট কমিটির অনুরোধে ঠিকই মাঠে নেমে ছিলাম।

অমলেশ বললেন, ১৫ আগস্ট নির্মম ঘটনার পর আমরা লিগে প্রথম ম্যাচ খেলি দিলকুশার বিপক্ষে। দল গড়ার পর আবাহনীর তখন সাপোটার ছিল না। পুরো গ্যালারি ছিল আমাদের বিপক্ষে। বিপদ ঘটতে পারে তা জেনেও মাঠে গেলাম। দেখলাম অন্য এক দৃশ্য, যা দেখে আমরা চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি। পুরো গ্যালারি আবাহনী আবাহনী বলে চিৎকার করছে, যা আমরা কল্পনাও করিনি। চোখে পানি। অথচ বিপুল করতালিতে আমরা মাঠে নামলাম। সেই দৃশ্য এখনো ভুলতে পারিনি। আবাহনী শুধু টিকে থাকেনি, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্লাবে পরিণত হয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি বড় তিন খেলাতেই সর্বোচ্চ লিগে জিতে তার প্রমাণ মিলেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর