মোহাম্মদ আলী যদি বক্সিং না খেলে বাস্কেটবল খেলতেন! পেলে-ম্যারাডোনা যদি ফুটবলের পরিবর্তে হকি খেলতেন! কিংবা শচিন টেন্ডুলকার ক্রিকেট না খেলে যদি ফুটবল খেলতেন! —তাহলে কী আজকের বিশ্ব চিনতো মোহাম্মদ আলী, পেলে, ম্যারাডোনা, টেন্ু্ভ্রলকারকে?
আজ তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ‘মহাতারকা’ হয়েছেন নিজের ‘পারফেক্ট’ ক্রীড়া ইভেন্টটি বেছে নিতে পারছিলেন বলেই।
শুনে অবাক হবেন, ছোটবেলায় জ্যামাইকান বিদ্যুৎ উসাইন বোল্টের নাকি ধ্যান-জ্ঞান ছিল গলফ! সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গলফ কোর্সে। কিন্তু মা চাইতেন তার ছেলে ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে’ মনোযোগ দিক। আর মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই এক স্কুল প্রতিযোগিতায় দৌঁড়ে অংশ নেন। সেখানে প্রথম হওয়ার পরই পাল্টে যায় বোল্টের প্যাশন! ধীরে ধীরে স্প্রিন্টের প্রেমে পড়ে যায়। সেই ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড’ থেকেই বোল্ট এখন সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদের মর্যাদায় আসীন!রিও অলিম্পিকে ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার প্রিন্টে সোনা জয়ের পরও বাজিমাৎ করে দিলেন ৪দ্ধ১০০ মিটার রিলেতেও। স্বদেশি তিন স্প্রিন্টার আসাফা পাওয়েল, ইয়োহান ব্লেক ও নিকেল আশমেডকে নিয়ে জিতেছেন সোনা। রিওতে তিনে তিন! বোল্টের দল সময় নিয়েছে ৩৭.২৭ সেকেন্ড। দলগত এই ইভেন্ট থেকে সিলভার জিতেছে জাপান। তারা সময় নিয়েছে ৩৭.৬০ সেকেন্ড। ৩৭.৬৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছে কানাডা।
গতকাল ৪দ্ধ১০০ মিটার রিলেতে সোনা জয়ের পর বোল্টের ‘ট্রিপল ট্রিপল’ স্বপ্নপূরণ হয়ে গেছে বিশ্বের দ্রুততম মানবের। সেই সঙ্গে বোল্ট যেন তার অমরত্ব নিশ্চিত করলেন। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক, ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক ও ২০১৬ রিও অলিম্পিক— টানা তিন আসরে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪দ্ধ১০০ মিটার রিলে থেকে টানা নয়টি সোনা জিতে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে যেন ডায়মন্ডের হরফে নিজের নাম লিখলেন উসাইন বোল্ট।
অলিম্পিকে ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড’ থেকে ৯টি সোনা জয় করা সম্ভব কিন্তু এমন একটি বিরল হ্যাটট্রিক করা কী চাট্টিখানি কথা! বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসহ মোট ২০টি সোনা জিতেছেন বোল্ট। এমন কীর্তি গড়ার পর বোল্টের নিজেরই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কারণেই কিনা ‘ট্রিপল ট্রিপল’ হ্যাটট্রিক হওয়ার পর স্প্রিন্ট সম্রাট সদর্পে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এই রেকর্ড কখনো ভাঙবে না!’
তবে গতকাল বেশ খানিকটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন বোল্ট—শেষ পর্যন্ত ৪দ্ধ১০০ মিটার রিলেতে সোনা হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো! কেন না এই ইভেন্টটি বোল্টের একার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। অন্য তিনজনের মধ্যে কেউ যদি ‘ব্যাটন’টা হাত থেকে ফেলে দিতেন। কিংবা ফলস স্টার্টও হতো পারতো! যেমন এবারই বোল্টদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাটলিন-টাইসন-গে-দের যুক্তরাষ্ট্র ডিসকোয়ালিফাইড হয়েছে। তাই দৌড় শুরুর পর যখন দেখলেন আসাফা পাওয়েল ঠিকঠাক মতোই শুরু করেছেন তখন কিছুটা স্বস্তি। তার হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে ইয়োহান ব্লেক দক্ষতার সঙ্গেই তুলে দেন তিন নম্বর স্প্রিন্টার নিকেলের হাতে। শেষ স্প্রিন্টার হিসেবে অ্যাংকর লেগে অপেক্ষমাণ বোল্ট ব্যাটন নিয়ে সবার আগে ছুঁয়ে ফেলেন টাচ লাইন। তবে নিজের উদ্বিগ্নতার কথা বলতে গিয়ে বোল্ট জানান, ‘আমি ওদের দৌঁড় দেখছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম, যেন কোনো ভুল না হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাটনটা হাতে পাওয়ার পর মনে হলো আমিই জিততে যাচ্ছি। কেউ আমাকে অ্যাংকর লেগে হারাতে পারবে না।’
ইতিহাস গড়ার পর বোল্ট নানা ভঙ্গিতে সেলিব্রেশন করতে থাকেন। হাতের মুঠোয় নেন প্রিয় জ্যামাইকার পতাকা। রিওকে স্মরণীয় করে রাখতে গায়ে জড়িয়ে নেন ব্রাজিলের পতাকা। এ সময় গ্যালারির দর্শকরা দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান দ্রুততম মানবকে।
রিও অলিম্পিকের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গেল বোল্টের অলিম্পিক অধ্যায়। তবে আগামী বছর লন্ডনে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পরই ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড’ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে নেবেন। তবে গতকাল অলিম্পিকের বিদায়ী লগ্নটা যেন বোল্টকে কিছুটা আবেগতাড়িত করে তোলে— ‘আমি জানতাম, একদিন না একদিন আমাকে থামতেই হবে। আমি অবশ্যই এই দর্শক ও উন্মাদনাকে মিস করব। এই প্রতিযোগিতাকে মিস করব। এমন অর্জনের পরও তাই আমার কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। সত্যিই আমার ক্যারিয়ারটা অন্যরকম ছিল। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে যা যা করতে চেয়েছি সবই তো করেছি। এখন জীবনের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।’
সংক্ষেপে সাফল্যের রহস্য বলতে গিয়ে বোল্ট জানান, ‘আমি সময়ই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। কখনোই কোনো অর্জনে সন্তুষ্ট থাকিনি। প্রতিটি অলিম্পিকে এই তিনটি সোনার মেডেলের জন্য কতোই না পরিশ্রম করেছি। তাই সফলভাবে মিশন সম্পন্ন করতে পেরে আমি খুব খুশি।’
আজ বোল্টের জন্মদিন। ৩০ বছরে পা দেওয়ার ঘণ্টা দুয়েক আগেই জন্মদিনের সবচেয়ে বড় উপহারটা পেয়ে গেছেন দ্রুততম মানব। সর্বকালের সেরা বলে কথা! তা না হলে জন্মদিনে এমন উপহার কজনের ভাগ্যে জোটে!