বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সেই ক্রিকেটই বাংলাদেশের গর্ব

ক্রীড়া প্রতিবেদক

সেই ক্রিকেটই বাংলাদেশের গর্ব

দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে ক্রিকেটকে ঘিরে তখন শঙ্কিত ছিল সবাই। এখন সেই ক্রিকেটই বাংলাদেশের গর্ব। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের আগেই বিশ্বকাপ খেলে ফেলে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডস। এমন ভরাডুবি দেখে ক্রীড়ামোদীরা এতটা হতাশ হয়ে পড়েন যে অনেকে বলেই ফেললেন, ক্রিকেটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শুধু তাই নয়, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এক অনুষ্ঠানে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ক্রিকেটে আর অর্থ দেওয়া হবে না। অযথা অর্থ খরচ করে লাভ নেই। ক্রিকেটে তখন বড্ড দুঃসময় নেমে এসেছিল। কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছিলেন না ক্রিকেটাররা। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় সার্ক ক্রিকেটে বাংলাদেশ রানার্সআপ হওয়ায় কিছুটা আশার আলো জেগে ওঠে। ফাইনালে দুর্ভাগ্যক্রমে প্রবীণ আমরের নেতৃত্ব দেওয়া ভারতের কাছে হেরে যায়।

ক্রিকেটের আকাশে কালো মেঘ দূর হতে থাকে মূলত ১৯৯৬ সাল থেকে। নতুন কোচ নিয়োগ দেওয়া হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার গর্ডন গ্রিনিজকে। তারই প্রশিক্ষণে সেবার সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারিয়ে এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এগিয়ে চলার রাস্তা খুজে পায় বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালকে বলা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন জন্ম। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে চরম হতাশার পরিচয় দেয় বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে সেই হতাশা ঝেড়ে ফেলে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথমবারের মতো স্বপ্নের বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ মেলে। সেমিফাইনালে জেতার পরই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ  খেলা নিশ্চিত হয়। জয়ের পর সারা দেশজুড়ে উৎসবের ঝড় বয়ে যায়। অনেকের মতে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বরের পর এমন উৎসব দেখা গেল। ফাইনালে কেনিয়াকে হারানোর পর উৎসবে ভেসে যায় দেশ। ক্রিকেটাররা দেশে ফেরার দিনই শেরেবাংলা নগরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধনা দেন। অনুষ্ঠানে লাখো জনতা সমবেত হয়। সেই থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নবযাত্রা।

১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের অভিষেকেই বাজিমাত করে ফেলেন বুলবুল, আকরাম, সুজনরা। শুধু স্কটল্যান্ড নয়, পাকিস্তানের মতো বাঘা দলকে পরাজিত করে। এই পাকিস্তানই সেবার বিশ্বকাপে রানার্সআপ হয়। পাকিস্তানকে হারানোর পরই ক্রিকেটাররা টাইগারের খ্যাতি পেয়ে যায়। ২০০৩ বিশ্বকাপটা সুখকর না হলেও ২০০৭ সালে রীতিমতো আলোড়ন তুলে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দেশকে পরাজিত করে। ২০১১ সালে ইতিহাসই গড়ে ফেলে টাইগাররা। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে। ভারতের কাছে হেরে সেমিতে উঠতে না পারলেও অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন পক্ষপাতিত্ব অ্যাম্পায়ারিং না হলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত। ওয়ানডেতে এমন কোনো দেশ নেই যে বাংলাদেশের কাছে হারেনি। জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজও জিতেছে। এশিয়া কাপে রানার্সআপ ও এশিয়ান গেমস ইতিহাসে একমাত্র সোনা এসেছে ক্রিকেট থেকেই। টি-২০তেই পারদর্শিতার ছাপ রাখছে।

টেস্টেও কম কীসের? ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর অনেকে বাংলাদেশকে নিয়ে নাক ছিটকিয়েছিলেন। আইসিসির সভায় বলা হয়েছিল এতে টেস্টের সৌন্দর্য ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। তাদের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে টাইগাররা। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে মাত্র চার বছরের মাথায় সিরিজ জেতার গৌরব অর্জন করে। এই ইতিহাস লেখা হয়ে যেত ২০০৩ সালেই। কিন্তু মুলতানে জেতা ম্যাচে পাকিস্তানকে হারাতে পারেননি সুজনরা। অভিষেক টেস্টে ভারতের কাছে হারলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি কম ছিল না। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সেঞ্চুরি ও নাইমুর রহমান দুর্জয়ের ৫ উইকেট বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে।

টেস্টে জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শুধু সিরিজ জেতার কৃতিত্ব রয়েছে। কিন্তু অন্যদের বিপক্ষে কি খারাপ খেলছে? ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়া ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এবার চট্টগ্রামের ট্র্যাজেডি ভোলবার মতো নয়। ১৫ মাস পর টেস্টে নেমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে তা সত্যিই অসাধারণ। জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তীরে এসে তরী ডুবিয়েছে টাইগাররা। জয়ের পর ইংল্যান্ড অধিনায়ক কুকই বলেছেন, বুকের ওপর থেকে শক্ত পাথর যেন সরে গেল। সুতরাং এই পারফরম্যান্সই বলে দিচ্ছে টেস্টেও সুদিন আসছে বাংলাদেশের।

সাকিব আল হাসান বেশ কবার আইসিসির সেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন। মুস্তাফিজ তো ক্রিকেটে নতুন বিষ্ময় বালক। সোহাগ গাজী বিশ্বে একমাত্র ক্রিকেটার এক টেস্টে হ্যাটট্রিক ও সেঞ্চুরির কৃতিত্ব পেয়েছেন। মেহেদীই বা কম কিসের? অভিষেক টেস্টেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭ উইকেট তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটার ছাড়া বিদেশি লিগ চলেই না। যার বড় প্রমাণ আইপিএলে। সাকিবের কৃতিত্বে কলকাতা নাইট রাইডার্স শিরোপা জিতেছে। মুস্তাফিজ প্রথমবার খেলতে গিয়েই ভারত কাঁপিয়েছেন। তারই বোলিং জাদুতে হায়দরাবাদ আইপিএলের ট্রফি ঘরে তুলেছে। বিশ্লেষকরাই বলছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে সামনে বিশ্বকাপ জিতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মানের অবনতিতে ফুটবলে জনপ্রিয়তার ধস নেমেছে। আর যে ক্রিকেট দিয়ে কিছুই হবে না বলে ভাবা হয়েছিল সেই ক্রিকেটই এখন বাংলাদেশের গর্ব। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা যেমন ফুটবলে তেমনিভাবে ক্রিকেটের জন্যই বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ খবর