রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাঙালি ফুটবলারদেও উপহাস করা হতো

ক্রীড়াঙ্গনও শোষিত ছিল

ক্রীড়া প্রতিবেদক

বাঙালি ফুটবলারদেও উপহাস করা হতো

জাকারিয়া পিন্টু

ক্রীড়াঙ্গনও শোষণ করে রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। যোগ্যতা থাকার পরও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে খেলতে দেওয়া হতো না। মান ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল অনেক এগিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানে সেই ধরনের আসর বা ফুটবলাররা পারিশ্রমিক পেতেন না বলে অনেক অবাঙালি ফুটবলার ঢাকার প্রথম বিভাগ লিগে অংশ নিতেন। অথচ জাতীয় দল গঠনের সময় বাঙালি ফুটবলারদের গুরুত্ব দেওয়া হতো না। পারফরম্যান্স থাকার পরও ষাট দশকের শুরুর দিকে শুধু নবী চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। একবার তাকে অধিনায়কও করা হয়েছে। কেন জানি বাকিদের দিকে দৃষ্টিও দেওয়া হতো না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো বাঙালি ফুটবলারদের।

ষাট দশকের শেষের দিকে এসে তৎকালীন পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন বিপাকে পড়ে। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি ফুটবলারদের দিয়ে জাতীয় দল গঠন করা যাচ্ছিল না। নিরুপায় হয়ে ১৯৬৮ সালে ট্রায়ালে ডাকা হয় জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, গোলাম সারওয়ার টিপু, শহিদুর রহমান শান্টু, হাফিজউদ্দিন ও নুরুন্নবীকে। এসব বাঙালি ফুটবলার ৬৮ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেন। বাঙালি বলে উপহাস করা হতো পিন্টুদের।

এ ব্যাপারে পিন্টু বলেন, ‘ঢাকায় কখনো জাতীয় দলের ট্রায়াল হতো না। আমাদের উড়ে যেতে হতো করাচি বা রাওয়ালপিন্ডিতে। আমরা যখন অনুশীলন করতাম তখন কর্মকর্তারা উর্দু ভাষায় বলতেন চাউল খাকা লাড়কা নেহি চলে গা। মানসিক একটা চাপে রাখা হতো। বিশ্বাস করবেন না আমরা যেন মূল দলে সুযোগ না পাই অনুশীলনের সময়ও মারাত্মক ফাউল করা হতো। কষ্ট লাগে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে ঢাকা লিগে একসঙ্গে খেলতাম তারাও কর্মকর্তাদের নির্দেশে বল ছেড়ে অনুশীলনের সময় অযথা আমাদের লাথি মারত। তবে গফুর বেলুচ, মওলা বক্স ও আবিদ ছিল ব্যতিক্রম। ওরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলত বাঙালিদের সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে কেন?’

পিন্টু আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ’৭০ সালে আলী নেওয়াজ কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ রাখেন আমাকে অধিনায়ক করতে। এ কথা শুনে যেন কর্মকর্তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, কোনোভাবেই পিন্টুকে অধিনায়ক করা যাবে না। কারণ ও বাঙালি। ক্যাম্পে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য উন্নতমানের খাবার দেওয়া হলেও আমাদের সকালে দুই পিস পাউরুটি আর সামান্য জেলি। দুপুরে ও রাতে মোটা রুটির সঙ্গে শুধু ডাল। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই বলা হতো যদি ভালো না লাগে ঢাকায় ফিরে যাও। এমন আচরণের পরও বাঙালিরাই ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করত।

১৯৭০ সালে আরসিডি কাপে আমার ও সান্টুর নৈপুণ্য দেখে তুরস্কের এক বিখ্যাত ক্লাব অফারও দিয়েছিল। এই কথা জানার পর পাকিস্তানের ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা শাসিয়ে বললেন, তোমরা দেশের বাইরে লিগ খেললে আজীবন সাসপেন্ড করা হবে। মানসিক চাপে আমরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি ডাক পেলেও আর পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলব না। প্রয়োজনও পড়েনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা স্বাধীন বাংলা দল গঠন করি। ১৯৭৩ সালে আমরা বাংলাদেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্রীড়াঙ্গনকে কতটা শোষণে রেখেছিল তা আমি বলে শেষ করতে পারব না।

সর্বশেষ খবর