সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ক্রিকেট নেশায় মেতেছে পাবনার মেয়েরা

সৈকত আফরোজ আসাদ, পাবনা

ক্রিকেট নেশায় মেতেছে পাবনার মেয়েরা

মনোযোগ সহকারে ক্রিকেট অনুশীলনে ব্যস্ত পাবনার কিশোরীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই যে গ্রামে মেয়েদের বসিয়ে দেওয়া হতো বিয়ের পিঁড়িতে, সে গ্রামের মেয়েরাই আজ মেতেছে ক্রিকেট নেশায়। গ্রামবাসীর উৎসাহে তাদের স্বপ্ন এখন জাতীয় দলে খেলার। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ অসম্ভবকে বাস্তবে পরিণত করেছে পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের মাধপুর ডা. ইসমাইল হোসেন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

পাবনা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মাধপুরে নারী শিক্ষা বিস্তারে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডা. ইসমাইল হোসেন মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। গ্রামীণ সংস্কার আর বাল্যবিবাহের সঙ্গে যুদ্ধ করে কদিন আগেও যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ধরে রাখতেই হিমশিম খেতেন শিক্ষকরা, শিক্ষার্থীদের দৃঢ়তা আর প্রত্যয়ে তারাই এখন গাইছেন দিনবদলের গান। এক ঝাঁক কিশোরী ব্যাট বল নিয়ে সপ্তাহে দুদিন নিয়ম করে স্কুল মাঠে করছে অনুশীলন।

সাকিব, তামিম, মাশরাফিদের খেলা দেখে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলেও তাদের আদর্শ সালমা, রোমানা, আয়শারা। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে বিভোর এ কিশোরীদের উন্মাদনার পালে হাওয়া দিয়েছেন শরীরচর্চা শিক্ষক তুহিন হোসেন। শুধু প্রশিক্ষণই নয় স্কুল থেকে আদায় করেছেন খেলার সরঞ্জাম। সরজমিনে ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় মাঠে অনুশীলনে ব্যস্ত এক ঝাঁক দুরন্ত কিশোরী। শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল মনে হলেও তাদের উৎসাহে ঘাটতি নেই একটুও। শরীরচর্চা শিক্ষক তুহিন হোসেন হাতে ধরে দেখিয়ে দিচ্ছেন ফিটনেস ঠিক রাখার বিভিন্ন কৌশল। এ প্রতিবেদকের অনুরোধে শিক্ষার্থীদের দুদলে ভাগ করে ম্যাচ খেলার আয়োজন হলো। আর সেখানেই বিস্ময়ের সূচনা। মুহূর্তেই জমে গেল শখানেক দর্শক। মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে দেখা গেল চার ছক্কার ফুলঝুরি। মাত্র মাস ছয়েক আগে খেলতে শুরু করা এ কিশোরীদের খেলায় পাওয়া গেল অনেকটাই ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ এবং নিয়মিত অনুশীলনের ছাপ।

ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় সায়মা সুলতানা জানান, আমরা যখন প্রথম স্কুল মাঠে খেলতে শুরু করি, তখন অনেকেই হাসাহাসি করত। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা পাশে ছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণায় এখন আমরা নিয়মিত খেলাধূলা করি। আর গ্রামের মানুষ সে খেলা দেখে আনন্দ পায়। একই দলের ওপেনার শারমিন জানায়, সালমা, রোমানা আপারা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে দেশ বিদেশে নাম করছে। আমরাও তাদের মতো একদিন জাতীয় দলে খেলতে চাই।

পরিবার বাধা দেয় কিনা সে প্রশ্নের জবাবে ওই বিদ্যালয়ের তানিয়া জানায়, বাবা মা আমাদের যথেষ্ট উৎসাহ দেন। বাইরের কোনো লোক কটূ মন্তব্য করলে তারা আমাদের পক্ষ নিয়ে তাদের বোঝান। ক্রিকেটপাগল এ কিশোরীদের স্বপ্ন ছুঁয়েছে এলাকাবাসীকেও। অনুশীলনে পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারি সহযোগিতা চান তারা।

মাধপুর গ্রামের সন্তান ও ডা. ইসমাইল হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক অপু হোসেন জানান, কিছুদিন আগেই এ গ্রামে  সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। বাল্যবিবাহের কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী ধরে রাখাই ছিল কঠিন ব্যাপার। অথচ ভাবতে অবাক লাগে সে গ্রামের মেয়েরাই এখন ক্রিকেট খেলে নাম করেছে। একটু সহযোগিতা পেলে তারা একদিন জাতীয় দলে খেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম পরিচালক ও টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে। তৃণমূলের নারী ক্রিকেটার তৈরিতে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বিসিবির এই পরিচালক জানান, আমাদের মাঝে মধ্যেই ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম হয়। সেখানে অংশ নিয়ে বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এ মেয়েরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের সুযোগ নিতে পারে। এ ছাড়া পুরো দলকে স্থানীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতারও সুযোগ রয়েছে।

সাকিব, তামিম আর মাশরাফিদের পাশে বিশ্ব ক্রিকেটে এখন পরিচিত নাম সালমা, জাহানারা, রোমানারা। মাধপুরের আত্মপ্রত্যয়ী এ কিশোরীদের স্বপ্নে ভর করে ক্রিকেট বিশ্বও একদিন দেখবে বাঙালি নারীর বিশ্ববিজয়ীরূপ, অন্তত সে বাজিই ধরছেন এই গ্রামের মানুষ।

সর্বশেষ খবর