শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইতিহাসের সেরা সফর বাংলাদেশের

মেজবাহ্-উল-হক

বিদেশ সফর মানেই অসহায় আত্মসমর্পণ! কিন্তু এবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেট যে কতটা এগিয়ে গেছে তা বোঝা গেল শ্রীলঙ্কা সফরেই। তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই দাপটের সঙ্গে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজ জিততে না পারলেও হারেনি টাইগাররা। তিন সিরিজেই ১-১ ড্র। তাই এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসেই সেরা সফর।

দেশের বাইরে বাংলাদেশ এর আগে কেবল দুটি দেশকেই টেস্টে হারিয়েছিল— ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েকে। তবে ২০০৯ সালে টাইগাররা যে উইন্ডিজ দলকে হারিয়েছিল সেটি তাদের সেরা দল ছিল না। ওই সময় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলার কারণে সেরা তারকা ক্রিস গেইল, রামনরেশ সারওয়ানরা দলে ছিলেন না। সম্পূর্ণ তরুণ এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। তাই জয় পেলেও টাইগাররা আসলে বড় দলকে হারানোর তৃপ্তি পাননি।

জিম্বাবুয়েকেও তাদের মাটিতে হারিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই জিম্বাবুয়ে তো এমনিতেই র‌্যাঙ্কিংয়ে টাইগারদের নিচে। তাই বিদেশের মাটিতে পাওয়া এই জয় বাংলাদেশ আলাদাভাবে তুলে ধরেনি। তবে এবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জয়টি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।

একে তো লঙ্কানরা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে, তার ওপর এই দলটির বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই হোয়াইটওয়াশ হয়েছে টেস্টে মহাশক্তিধর দল অস্ট্রেলিয়া। সেই দলটিকেই কিনা নাস্তানাবুদ করে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। সেটা কিনা ছিল আবার বাংলাদেশের শততম টেস্ট। সব মিলে লঙ্কানদের বিরুদ্ধে এই জয়টি টাইগারদের ক্রিকেটাতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা।

আইসিসির টি-২০ র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দশম স্থানে। টাইগারদের উপরে রয়েছে আফগানিস্তান! কেন যেন এই ফরম্যাটের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছিলেন না ক্রিকেটাররা। সে কারণেই একের পর এক ম্যাচে হারতে হয়েছে। গত টি-২০ বিশ্বকাপের সুপার সিক্স পর্ব থেকে টানা ৮ ম্যাচে হেরে টাইগারদের আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকেছিল তলানীতে। অন্য দিকে শ্রীলঙ্কা দলটি টেস্টের চেয়েও টি-২০তে ছিল ভয়ঙ্কর। সব শেষ সিরিজে এই দলটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে সিরিজ জিতেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও তারা জিতেছে। বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, সেই দলটি দেশের মাটিতে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে!

প্রথম ম্যাচে টাইগারদের উড়িয়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কা তাদের টি-২০ শক্তিমত্তার জানানও দিয়েছে। কিন্তু পরের ম্যাচেই বাংলাদেশ তাদের ৪৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ এখন আর আগের মতো দুর্বল নয়। ম্যাচে লঙ্কানদের পাত্তাই দেয়নি টাইগাররা।

ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নতিটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঊর্ধ্ব গতিটা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রথমবারের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর থেকে। তারপর ঘরের মাঠে একে একে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিধর প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে সিরিজ জেতে টাইগাররা। দিন দিন যেন টাইগারদের আত্মবিশ্বাস বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু দেশের মাটিতে সব শেষ ওয়ানডে সিরিজে হেরে যায় বাংলাদেশ। তারপর নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় গিয়ে ঠিক নিজেদের আলাদা করে চিনিয়েছেন মাশরাফিরা।

প্রথম ম্যাচেই দারুণ এক জয়। তবে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়ে সমতা আনে লঙ্কানরা। তবে দ্বিতীয় ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হওয়ায় আফসোস হতে পারে ক্রিকেটারদের। তা না হলে সিরিজটা অন্যরকম হতে পারত। তারপরেও শ্রীলঙ্কায় গিয়ে স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে সমতায় সিরিজ শেষ করতে পারাও তো চাট্টিখানি কথা নয়। সব মিলে শ্রীলঙ্কা সফরটি ছিল বাংলাদেশের জন্য সাফল্যে ভরপুর এক সিরিজ।

এই সিরিজে দলীয় সাফল্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটাও পূর্ণ হয়ে গেছে। শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। শুধু তাই নয়, টেস্ট সিরিজের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও উঠেছে সাকিবের হাতে।

অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন তামিম ইকবাল। শততম টেস্টের দুই ইনিংসেই অসাধারণ ব্যাটিং করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। দুই টেস্টে ৫১.৭৫ গড়ে ২০৭ রান করেছেন তিনি।

ওয়ানডে সিরিজে উইকেট শিকারের দিক দিয়ে শীর্ষ তিন বোলারই বাংলাদেশের। তিন পেসার মাশরাফি, তাসকিন ও মুস্তাফিজ নিয়েছেন ৬টি করে উইকেট। তবে এই সিরিজের সব আলো যেন পড়েছে তাসকিনের ওপর। দারুণ এক হ্যাটট্রিক করেছেন বাংলাদেশের এই গতি তারকা।

টি-২০ সিরিজে সৌম্য সরকারের ড্যাসিং ব্যাটিং, কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং এবং সাকিবের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স যোগ করে বাড়তি মাত্রা। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের এই ক্রিকেটেও যে বাংলাদেশ উন্নতি করছে তার বড় উদারহণ হয়ে থাকবে শ্রীলঙ্কা সফরের শেষ ম্যাচটি।

শেষের এই ম্যাচটি ছিল মুস্তাফিজুর রহমানকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার ম্যাচ। কেননা দীর্ঘদিন ইনজুরিতে ভোগার পর কাটার মাস্টার ফিরলেও তার সেরা ফর্ম ছিল না। আগের ম্যাচেই টি-২০ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে বোলিং করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ ম্যাচে দেখা গেল সেই ভয়ঙ্কর মুস্তাফিজকে। মাত্র ২১ রানে নিয়েছেন চার উইকেট।

সব মিলেই এবারের এই শ্রীলঙ্কা সফরটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা সফর।

সর্বশেষ খবর