মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেই ফুটবলের একি চেহারা!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

সেই ফুটবলের একি চেহারা!

নব্বই দশকেও ফুটবল লিগে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে ভরে যেত পুরো গ্যালারি। বর্তমান প্রজন্মের ক্রীড়ামোদীদের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। কেননা ডানের ছবিতে ২০১৬ পেশাদার লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের লড়াইয়ে গ্যালারি ছিল প্রায় ফাঁকা। ফুটবলে এই দৃশ্য এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক যেন এখন সোনার হরিণ —ফাইল ফটো

১৯৯৩ সালের কথা। তৎকালীন বিসিসিবি যুগ্ম-সম্পাদক গোলাম ফারুক অপু স্টেডিয়ামের তিন তলায় বাফুফে ভবনে এসে হাজির। সাধারণ সম্পাদক আকমল হোসেনের রুমে সাংবাদিক গিজগিজ করছিল। সবাই জানতে এসেছেন সাফ গেমসের ফুটবল দল কবে ঘোষণা হবে। বা কে হচ্ছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক তা জানতে। এ সময় অপু বলে উঠলেন এখানে এত সাংবাদিক অথচ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড পুরো শূন্য। কেউ আমাদের খবরই নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। কেন ভাই ক্রিকেট কী কোনো খেলার মধ্যে পড়ে না। বর্তমান প্রজন্মের ক্রীড়ামোদীদের বিশ্বাস করানো মুশকিল হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন এতটাই করুণ দশা ছিল। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে চরম ভরাডুবির পর অনেকে তো ধরেই নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট শেষ হয়ে গেছে। একে আর কখনো জাগানো যাবে না। শুধু কি তাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এক অনুষ্ঠানে তখনকার যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকাকে উদ্দেশ করে বলেন, তুমি আর কখনো ক্রিকেটের জন্য টাকা পাবে না। পারলে দেশের কথা ভেবে এই খেলা বন্ধ রাখ।

ক্রিকেটের এই করুণ অবস্থায় ফুটবলে ছিল ঝলমলে আলো। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বড় কোনো সাফল্য ছিল না। এমনকি বাংলাদেশের আগে সাফ গেমসে সোনা জিতেছিল ভারত, নেপাল বা পাকিস্তানও। তারপরও ফুটবল জুড়ে সে কি উন্মাদনা। স্বাধীনতার কয়েক মাস পরই মাঠে গড়িয়েছিল ফুটবল। পুরো গ্যালারি ভরে যেত প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই। জাকারিয়া পিন্টু, আবদুস সাদেক, শহিদুর রহমান শান্টু, প্রতাপ হাজরা, কাজী সালাউদ্দিন, গোলাম সারোয়ার টিপু, হাফিজউদ্দিন, কায়কোবাদ, নওশের, অমলেশ সেন, ছোট নাজির তারা ছিলেন বড় তারকা। সালাউদ্দিনের বিয়ে নিয়ে ওই সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছিল। এরপর মনোয়ার হোসেন নান্নু, শামসুল আলম মঞ্জু, এনায়েত হোসেন, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল তারকার খ্যাতি পান। এতটা জনপ্রিয় ছিলেন রাস্তাঘাটে তাদের দেখা মিললেই শত শত ভক্ত ভিড় জমিয়ে ফেলতেন।

মোহামেডান-আবাহনীর ফুটবল মানেই দেশ জুড়ে যেন যুদ্ধ বেধে যাওয়া। ১৯৭৮ সালে ওয়ারীর কাছে হারার পর আবাহনী সমর্থকদের ওয়ারী আইল বলে খেপানো হতো। আন্তর্জাতিক নয় ঘরোয়া ফুটবলে তারকার কমতি ছিল না। আশির দশকে রামা লুসাই, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, খোরশেদ বাবুল, হাসানুজাম্মান বাবলু, গোলরক্ষক মহসিন, শেখ মো. আসলাম, ওয়াসিম, সম্রাট হোসেন এমিলি, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, সাব্বির, কানন, রুমি, মামুন জোয়ার্দার। পরবর্তীতে জুয়েল রানা, হাসান আল মামুন, মাসুদ রানা, আলফাজ ও নকিবরাও তারকার খ্যাতি পেয়ে যান। সত্যি বলতে কি ফুটবলে তখন তারকার কমতি ছিল না। এখন তো আবাহনী বা মোহামেডানের হারটা স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ১৫ বছর ধরে লিগ জিততে পারছে না। ’৭০ বা ’৮০-র দশকে এমন বিপর্যয় ঘটলে ক্লাবের কি অবস্থা হতো একবার ভেবে দেখুন।

এ নিয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। একটা উদাহরণ তুলে ধরলেই এখনকার ক্রীড়ামোদীরা বুঝতে পারবেন তখনকার ফুটবলে কতটা উত্তেজনা ছিল। ১৯৮৬ সালে সুপার লিগে আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ। জয় নয়, অন্তত ড্র করতে পারলে টানা চতুর্থবার লিগ জিতে নতুন এক ইতিহাস গড়ে ফেলবে আবাহনী। অন্যদিকে মোহামেডান একইভাবে শিরোপা থেকে বঞ্চিত থাকবে। এমনিতেই আবাহনী ছিল ব্যালেন্সড দল। তারপর আবার ট্রফি নিশ্চিত করতে ভারত থেকে উড়িয়ে এনেছিল ভাস্কর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ধর ও চিমাওকোরিকে। মোহামেডান ধরেই নিয়েছিল ম্যাচ জেতা যাবে না। তাই সকালেই ক্লাবে সিদ্ধান্ত হয় ম্যাচের পর কোনো খেলোয়াড় যেন ক্লাবে না ফিরে। কারণ গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিল ক্ষোভে সমর্থকরা ক্লাবে আগুন লাগিয়ে দেবে। সেই ম্যাচে অবিশ্বাস্যভাবে জয় পেয়েছিল মোহামেডান। গোল করেন মনু ও ইলিয়াস। আর এই জয়ে তিন বছর পর হারানো শিরোপা ফিরে পেয়েছিল সাদা-কালোরা।

এখন ১৫ বছর ধরে লিগ জিততে পারছে না। এ নিয়ে মোহামেডানের সমর্থকদের ভিতর হয়তো ক্ষোভ আছে। কিন্তু কোনো উত্তেজনা নেই। কারণ ফুটবলের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে বলা যায়। যখন জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় কোনো সাফল্য ছিল না। কিন্তু মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা ভুটান গোলের বন্যায় ভেসে যেত। জাতীয় দলের কথা বাদই দিলাম তারা মোহামেডান ও আবাহনীর সামনেও দাঁড়াতে পারত না।

কি করুণ পরিণতি, সেই মালদ্বীপই এখন বাংলাদেশকে নিয়ে ছেলেখেলা খেলে। ভুটানের কাছেও বিধ্বস্ত হচ্ছে। পেশাদার লিগ আবির্ভাবের পরও গ্যালারি থাকছে ফাঁকা। এক সময়ে দুপুরের আগেই গ্যালারি ভরে যেত। এখন দর্শক যেন ঘরোয়া ফুটবলে সোনার হরিণ। এক সময় ক্রিকেট বোর্ডে সাংবাদিকরা যেতেন না বলে কর্মকর্তারা আফসোস করতেন। এখন ক্রিকেট নিয়ে পুরো দেশ মাতোয়ারা। ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে ক্রিকেট। সাফল্যের পর সাফল্য আসছে। এখন শুধু অপেক্ষা করে ক্রিকেটে বিশ্ব জয়ের হাসি হাসবে। তাহলে কি ক্রিকেটের কারণে ফুটবলে করুণ দশা নেমে এসেছে। নাকি টিভিতে প্রতিদিন ইউরোপিয়ান লিগের মনোমুগ্ধকর খেলা দেখে দর্শকরা বাংলাদেশের ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, গোলাম সারোয়ার টিপু বা অনেক ফুটবল বিশ্লেষকই বলেছেন, কারণ একটাই মান কমে যাওয়ায় এমন বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে ফুটবল শেষ হয়ে গেছে এই কথা বললে ভুল হবে। ফুটবলকে জাগিয়ে তুলতে এখনো চেষ্টার কমতি নেই। যার প্রমাণ ঘরোয়া আসরে ক্লাবগুলোর পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর