সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আলো ছড়ানো তারকারা

একের ভিতরে দুই। ক্রীড়াঙ্গনে দুই খেলা খেলেছেন এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ইব্রাহিম সাবের ক্রিকেট, বাস্কেটবল এমনকি ফুটবলও খেলেছেন। নওশের ফুটবল ও ক্রিকেট, কাওসার আলী ফুটবল ও হকি, এহতেশামও একই সঙ্গে ফুটবল ও হকির গোলরক্ষক ছিলেন। কিন্তু একাধিক খেলায় সেভাবে তারা মাঠ কাঁপাতে পারেননি। বশির আহমেদ, আবদুস সাদেক, কাজী সালাউদ্দিন, প্রতাপ শংকর হাজরা, হাফিজউদ্দিন আহমদ, শহিদুর রহমান শান্টু ও রামা লুসাই ছিলেন ব্যতিক্রম। এরা দুই খেলাতেই আলো ছড়িয়েছেন। কেউ আবার একসঙ্গে জাতীয় বা ক্লাবকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৬০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত তাদের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। এরা কেউ ফুটবল, ক্রিকেট, হকি বা অ্যাথলেটিকসেও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। সেই তারকাদের ক্যারিয়ার নিয়েই এ আয়োজন।

 

ফুটবলে আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক

ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র আবদুস সাদেক। হকি খেলেই তিনি দেশব্যাপী পরিচিত হন। বাংলাদেশের হকির ইতিহাস লিখতে গেলে তারই নাম উচ্চারিত হবে সবার আগে। পূর্ব পাকিস্তানের অধিনায়ক ছাড়াও দ্বিতীয় বাঙালি খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলে সুযোগ পান সাদেক। ওই সময় বিশ্বজুড়ে হকিতে ছিল পাকিস্তানের দাপট। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দাপটের সঙ্গে খেলে যান তিনি। ক্রীড়ামোদীরা মূলত সাদেককে হকির লোক বলেই জানেন। ১৯৭২ সালে তারই প্রচেষ্টায় ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লিগে ঢাকা আবাহনীর অভিষেক ঘটে। ছিলেন আবাহনী দলের প্রথম অধিনায়ক। বেশ কয়েকবার শিরোপাও এনে দেন। সাদেকের বিচরণ শুধু হকিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ফুটবলও খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। আজকের দেশের জনপ্রিয় দল আবাহনীর ফুটবলে অভিষেক ঘটে ১৯৭২ সালে। ফুটবলে প্রথম নেতৃত্ব দেন সাদেকই। বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি কোনো নতুন দলের দুই খেলায় প্রথম অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। স্কুল ও কলেজ জীবনে অ্যাথলেটিকসেও অংশ নেন। অনেক পুরস্কারও জেতেন। কিন্তু খেলা হিসেবে হকি ও ফুটবলকে বেছে নেন সাদেক।

স্কুল জীবনেই হকির ক্যারিয়ার শুরু তার। নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জুনিয়র দল লাহোর সফর করে। সেই সফরে সাদেকের পারফরম্যান্স সবার নজরে পড়ে। ১৯৬১ সালে ঐতিহ্যবাহী আজাদ স্পোর্টিংয়ের হয়ে হকি লিগ শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে আরমানিটোলার পাড়ার দল কম্বাইন্ড স্পোর্টিংয়ে যোগ দেন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সাদেক এখানেই ছিলেন। তার নেতৃত্বে কম্বাইন্ড বেশ কয়েকবার শিরোপা জেতে। ১৯৭০ সালে সাদেক ইস্পাহানি ক্লাবে নাম লেখান। ১৯৭২ সালে আবাহনী। এরপর আর দল ছাড়েননি। অধিনায়ক ও প্রশিক্ষক হিসেবে আবাহনী লিগ ছাড়াও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলে সুযোগ পান। ১৯৬৮ সালে অধিনায়কও ছিলেন। ১৯৬৯ সালে সাদেক সুযোগ পান পাকিস্তান দলে। ওই সময় কোনো বাঙালি খেলোয়াড় পাকিস্তান দলে সুযোগ পাবে তা কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু যোগ্যতা দেখিয়ে সাদেক সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে পাকিস্তান দল ৪৫ দিনের সফরে আফ্রিকা ও ইউরোপের বেশকটি দেশে ম্যাচ খেলে। সাদেক সেখানে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। হকিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেন বেশ কয়েক বছর। কোচও ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ৮৫ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ৮৫ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপ অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও তিনি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। আসা যাক ফুটবলে। ১৯৭২ সালে নবাগত আবাহনী প্রথম ম্যাচ খেলে বিজেআইসির বিপক্ষে। সাদেকের নেতৃত্বেই ফুটবলে অভিষেক হয় এই দলের। রক্ষণভাগে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বেশ কয়েক বছর খেলে যান। ১৯৭৭ সালে তারই প্রশিক্ষণে ফুটবলে আবাহনী প্রথম অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়।

 

ক্রিকেটে অনবদ্য ৯৪ রান

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে কাজী সালাউদ্দিনের নামটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম সুপারস্টার তিনি। ১০ নম্বর জার্সিধারী সালাউদ্দিনের পায়ে যেন জাদু ছিল। কত গোল যে করেছেন তার হিসাব মেলানো মুশকিল। ফুটবলার সালাউদ্দিন ক্রিকেট খেলে যে মাঠ কাঁপিয়েছেন অনেকের হয়তো জানা নেই। আজাদ বয়েজ এক সময়ে ক্রিকেটে খ্যাতনামা দল ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে আজাদ বয়েজ এলিট ক্লাব বলেই পরিচিত ছিল। খেলতেন শামীম কবির, আশরাফুল, হীরা, তান্না, তানভীর, রকিবুল হাসান, ইউসুফ বাবুদের মতো তারকা। সালাউদ্দিন ছিলেন এই দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা কাপে এই দল চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডানকে হারিয়ে। সালাউদ্দিন অপরাজিত ৭০ রান করে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। লিগে তার একাধিক হাফ সেঞ্চুরিও ছিল। বিশেষ করে আবাহনীর বিপক্ষে ৯৪ রানের স্মৃতি এখনো ক্রীড়াপ্রেমীরা ভুলতে পারেননি। তারই ব্যাটিং ক্যারিশমায় সেবার আবাহনী লিগ শিরোপা থেকে ছিটকে যায়। জাতীয় দলে ট্রায়ালে বেশ কয়েকবার ডাকও পান। কিন্তু ফুটবলে ব্যস্ততার কারণে যোগ দিতে পারেননি। ঢাকা লিগে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয় টাউন ক্লাব থেকে। আর শেষ করেন লালমাটিয়া ক্লাবের হয়ে। ফুটবলে সালাউদ্দিনের যাত্রা হয় ঐতিহ্যবাহী ওয়ারী ক্লাব থেকে। দুই মৌসুম এখানে খেলেন। ১৯৬৯ সালে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে অনবদ্য হ্যাটট্রিক করেন। যা তার ক্যারিয়ারে প্রথম হ্যাটট্রিক। ১৯৭০ সালে সালাউদ্দিন যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে। তখন ঢাকা লিগে মাকরানিদের দাপট। কিন্তু তরুণ বয়সে সালাউদ্দিনের নৈপুণ্য দেখে দর্শক মুগ্ধ হয়ে যান। ১৯৭১ সালে মোহামেডানে থাকা অবস্থায় তিনি স্বাধীন বাংলা দলে খেলতে যান। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা কাপ দিয়েই দেশের ফুটবলে যাত্রা। সেই টুর্নামেন্টে মোহামেডানের হয়ে চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেন। সেমিফাইনালে বিজেআইসির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক আর ফাইনালে ইস্টঅ্যান্ডের বিপক্ষে তার দুই গোলে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়। অর্থাৎ ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক সালাউদ্দিনের। ১৯৭২ সালে ঢাকায় প্রীতি ম্যাচে তারই গোলে ঢাকা একাদশ পরাজিত করে বিখ্যাত মোহনবাগানকে। ১৯৭২ সালে বন্ধু শেখ কামালের ডাকে আবাহনীতে যোগ দেন। এক যুগ খেলে এই ক্লাব থেকে খেলোয়াড়ি জীবনে ইতি টানেন সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিন সুপারস্টারের খেতাবটা পান আবাহনী থেকেই। চারবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। অসংখ্য হ্যাটট্রিক ছাড়া দিলকুশার বিপক্ষে ডাবল হ্যাটট্রিকও আছে তার। ১৯৭৫ সালে আবাহনীর অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সালাউদ্দিনই প্রথম ফুটবলার যিনি দেশের বাইরে পেশাদারিত্ব লিগ খেলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি জাতীয় দলের অধিনায়কও হন। ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর আবাহনীর কোচের দায়িত্ব নেন সালাউদ্দিন। এনে দেন ফেডারেশন কাপ ও লিগ শিরোপা। জাতীয় দলেরও প্রশিক্ষক ছিলেন।

 

চোখ ধাঁধানো কর্নার শট

প্রতাপ শংকর হাজরার নাম যখনি ওঠে, চোখের সামনে ভেসে উঠে ফুটবল লিগে কর্নারের দৃশ্য। অসাধারণ কর্নার শট নিতেন। দর্শকরা বলতেন প্রতাপের কর্নার পেনাল্টি শটের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ১৯৭২ সালে মোহামেডানে পক্ষে কর্নারে টানা তিন গোল করে আজাদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকও করেন প্রতাপ। সে বছর মাঝপথে লিগ বন্ধ হয়ে যায়। তাই রেকর্ডবুকে এই বিরল কৃতিত্ব ঠাঁই পায়নি। ফুটবলার প্রতাপ হকিতে ছিলেন সমান পারদর্শী। ক্রিকেটও খেলেছেন। কিন্তু তারকার খ্যাতি পেয়েছেন ফুটবল ও হকি খেলেই। শুরুটা অবশ্য হকি দিয়ে।

১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণি পড়া অবস্থায় প্রতাপ হকি লিগ শুরু করেন ঐতিহ্যবাহী ওয়ারী ক্লাব থেকে। এরপর পুরান ঢাকার কম্বাইন্ড, আবাহনী ও মোহামেডানে খেলেন। কম্বাইন্ড, আবাহনী ও মোহামেডান থেকে একাধিকবার লিগ জেতেন। পাকিস্তান জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পেলেও খেলার সুযোগ হয়নি। তবে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। খেলা ছাড়লেও মোহামেডান ও জাতীয় দলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। হকি ফেডারেশনে বিভিন্ন পদের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬১ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে প্রতাপের অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়া থেকে। দুই মৌসুম খেলেন। ৬১ সালে রানার্সআপ ৬২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় ভিক্টোরিয়া। ১৯৬৩ সালে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে। ফুটবলে তারকার খ্যাতিটা পান সাদা-কালো থেকে। প্রতাপ নিজেও বলেন, মোহামেডান আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই ক্লাবের ঋণ কখনো শোধ করার মতো না। অধিনায়ক হননি, কিন্তু টানা সাত বছর সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন প্রতাপ। ফুটবলে অসংখ্য ট্রফি জিতেছেন মোহামেডান থেকেই। নিজে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের গোল করানোর জুড়ি ছিল না তার। এক আউটে প্রতাপ আরেক আউটে টিপু। প্রতিপক্ষদের কাটিয়ে যেভাবে ডিবক্সে বল ফেলতেন তা এখনকার ফুটবলারের কাছে স্বপ্নই মনে হবে। প্রতাপের কর্নার মানেই ছিল গোল। শট নেওয়ার আগেই সমর্থকরা উৎসবে মেতে উঠতেন।

পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন প্রতাপ। ১৯৬৪ সালে যুবদলের হয়ে রাশিয়া সফর করেন। ৬৫ সালে মূল দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা ও পরবর্তীতে ইরানে আরসিডি কাপ খেলেন। বিদেশে খেলারও অফার পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেশের টানে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে প্রদর্শনী ম্যাচেও অংশ নেন প্রতাপ।

বাংলাদেশে অনেক ফুটবলার ও হকি খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে প্রতাপের প্রশিক্ষণে। বর্তমানে তিনি মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে জড়িত

 

পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানব

হাফিজউদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। মন্ত্রীও ছিলেন তিনি। কিন্তু হাফিজের প্রথম পরিচয় কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবেই। মাঠ কাঁপানো ফুটবলার ছিলেন। সাদা-কালোর জার্সিতে তার দুর্দান্ত শট এখনো চোখে ভাসে। হাফিজ অ্যাথলেটিকসেও কিশোর বয়সে আলো ছড়িয়ে ছিলেন। শুনলে হয়তো অনেকে অবাক হবেন হাফিজ ছিলেন টানা তিন বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানব। ছাত্র জীবনেই ১৯৬৪, ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন হাফিজ। পাকিস্তান অলিম্পিক ট্রায়ালেও ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।১৯৬২ সালে ফায়ার সার্ভিস থেকেই হাফিজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৬৬ সালে ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালোর দল ঢাকা মোহামেডানে। ১৯৭৮ সাল থেকে এই ক্লাব থেকে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। তারকার খ্যাতিটি পান মোহামেডান থেকেই। পাকিস্তান জাতীয় দলেও খেলেছেন বেশ কয়েক বছর। ১৯৭০ সালে আরসিডি কাপে ইরানের বিপক্ষে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন। বাঙালি হয়েও পাকিস্তান দলে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু বিস্ময় হলেও সত্যি যে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে পারেননি। হাফিজ নিজেও বলেছেন এর পেছনে নানা ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। তবে কেউ আমার খেলা বন্ধ রাখতে পারেনি। ভক্তদের ভালোবাসায় ঠিকই খেলে গেছি। হাফিজ সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত গোলরক্ষক লাওন পিরিচ বলেছিলেন, ওর শট যেন বারুদের মতো। যা রুখে দেওয়া সত্যিই কষ্টকর। অনেক গোলরক্ষক হাফিজের শট ঠেকাতে আহত হয়েছেন। তাকে সামলাতে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ ভয়ে কাঁপত। কত গোল যে করেছেন তা হিসাব মেলানো যাবে না।

মোহামেডানে খেলে লিগ ও আগাখান গোল্ডকাপ জিতেছেন একাধিকবার। ১৯৭৬ সালে তিনি মোহামেডানের অধিনায়ক হন। নেতৃত্বের অভিষেকটা হয়েছিল দারুণভাবে। লিগের উদ্বোধনী ম্যাচেই শান্তিনগরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন হাফিজ। তার নেতৃত্বে সেবার মোহামেডান লিগ জিতে। সেমিফাইনালে বিজেএমসির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক আর ফাইনালে তারই দেওয়া দুই গোলে আবাহনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব তার। ১৯৭৩ সালে ফায়ার সার্ভিসের বিপক্ষে হাফিজ একাই ৬ গোল করেন। ফিফার বিশেষ পুরস্কার জেতেন বাংলাদেশের পক্ষে। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

 

একের ভিতরে দুই

 

হকিতে পাকিস্তান দলে প্রথম বাঙালি

ক্রীড়াবিদ বা সংগঠক। দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও দুই ক্ষেত্রে বশির আহমেদের অবদান ভুলবার নয়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত মুখ। হকি ও ফুটবলে সমানে মাঠ কাঁপিয়েছেন। বশিরকে আসলে কোথায় মানায়? এ কথা বললে তার বন্ধুরা বলেন, ফুটবল ও হকিতে চোখ বন্ধ করে একশ মার্কস দেওয়া যায়। ইনজুরির কারণে বেশিদিন খেলা হয়নি তার। যত দিন খেলেছেন ভক্তদের মন জয় করে গেছেন। বয়স হয়ে গেছে তার। অনেক কিছুই মনে করতে পারছেন না। তবে একটুকু বললেন, আমরা যতটা উজাড় করে খেলতাম এখন তা চোখে পড়ে না। ১৯৫৭ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে হকি খেলা শুরু করেন বশির। টানা কয়েক বছর কাটিয়ে ’৬৩ সালে যোগ দেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে। স্বাধীনতার পর যার নাম হয় সোনালী ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক থেকেই তিনি হকি ক্যারিয়ারে ইতি টানেন। প্রথম বাঙালি খেলোয়াড় হিসেবে বশির পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেন। ঢাকায় কেনিয়া ও হল্যান্ডের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অধিনায়ক হন। ইনজুরির কারণে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা সম্ভব হয়নি তার। বশিরের ফুটবল ক্যারিয়ারও শুরু হয় ভিক্টোরিয়া থেকে। ৫৭-৬২ সাল পর্যন্ত খেলেন এখানে। জেতেন লিগ শিরোপা ও আগাখান গোল্ডকাপ।  ৬৩ থেকে ৬৬ পর্যন্ত মোহামেডানে দক্ষতার সঙ্গে খেলে যান। হকির কোচ ও আন্তর্জাতিক অ্যাম্পায়ারও ছিলেন। অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

 

এক ওভারে তিন উইকেট

শহিদুর রহমান শান্টুকে চুম্বক বলেই ডাকা হতো। ফুটবলে তার মানের গোলরক্ষক দ্বিতীয়জন আসেনি। যতই কড়া শট নেওয়া হোক না কেন বল যেন তার হাতে চুম্বকের মতো আটকে যেত। ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, ইস্টঅ্যান্ড, আজাদ অনেক দলে খেলেছেন তিনি। সত্যি বলতে কি ক্রীড়াঙ্গনে শান্টুর পরিচয় ছিল ফুটবলে খ্যাতিমান গোলরক্ষক হিসেবে। কিন্তু ক্রিকেটেও দর্শকদের নজর কেড়েছেন তিনি। ৭০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত মোহামেডান ক্রিকেট দলের নিয়মিত খেলোয়াড় তিনি। মূলত মিডিয়াম পেসার বোলার। বাঁ হাতে বল করতেন। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিতেন। অসংখ্য উইকেট পেয়েছেন। সত্তর দশকে শহীদ স্মৃতি ক্রিকেটে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে এক ওভারে ৩ উইকেট পেয়ে মাঠ কাঁপান। ফুটবলে তারকা খ্যাতি পান ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে। দর্শকরা বলতেন শান্টু যেখানে গোলরক্ষক সেখানে ডিফেন্ডারদের প্রয়োজন পড়ে না। ১৯৭৬ সালে লিগ সেমিফাইনালে বিজেএমসির অসংখ্য আক্রমণ রুখে দেন মোহামেডানের শান্টু। শান্টুকে সামনে দেখে পেনাল্টি শটেও অনেকে নার্ভাসে বল উড়িয়ে মারতেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পান। শুরু থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি জাতীয় দলের অধিনায়ক  ছিলেন। ২০০৪ সালে জাতীয় দলের প্রশিক্ষকও ছিলেন।

 

বিকালে হকি রাতে ফুটবল

বিকালে হকি রাতে ফুটবল। হ্যাঁ রামা লুসাইকে তাই বলা হতো। হকি ও ফুটবলে সমান পারদর্শী ছিলেন। দুই খেলাতেই জাতীয় দলে সুযোগ পান। তা ছাড়া রামা একই সঙ্গে ফুটবল ও হকিতে মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বে মোহামেডান যেমন ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়, তেমনি হকিতেও। এ রেকর্ড আর কারও নেই। এশিয়ান গেমস এলেই ৭০ বা ৮০ দশকে বাফুফে ও হকি ফেডারেশন বিপাকে পড়ে যেত। কোন জাতীয় দলে খেলবেন তিনি ফুটবল না হকিতে। তার মতো পরিশ্রমী খেলোয়াড় খুব কমই দেখা গেছে। ১৯৮০ সালে এমনও দেখা গেছে বিকালে হকি লিগ খেলে সন্ধ্যায় আবার ফুটবল খেলছেন রামা। এই উদাহরণ কি অন্য কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে? পুলিশে চাকরির সুবাদে দুই খেলাতেই রামার ক্যারিয়ার শুরু হয় পুলিশ থেকে। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে। একইভাবে হকিতেও নাম লেখান সাদা কালোতে। ওই সময় মধ্য মাঠে রামা-ভানুর জুটি ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৭৮ সালে কিংস কাপে খেলতে যাবে জাতীয় ফুটবল দল। কিন্তু হকি ফেডারেশন তাকে ছাড়তে নারাজ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ফুটবলেরই জয় হয়েছিল। বর্তমানে রামা আসামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর