শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুপারহিট সুপার কাপ গেল কোথায়

ক্রীড়া প্রতিবেদক

সুপারহিট সুপার কাপ গেল কোথায়

ছবিই কথা বলে। ২০০৯ সালে প্রথম সুপার কাপ ফাইনালে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে উপচে পড়া দর্শক। অন্যদিকে পেশাদার লিগে গ্যালারি ফাঁকা। এতেই প্রমাণ মেলে বর্তমান ফুটবলের দুর্দশা —ফাইল ফটো

দেশের ফুটবলে গ্যালারি থাকছে প্রায় ফাঁকা। ক্লাবগুলো অঢেল অর্থ দিয়ে দল গড়লেও খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স খুবই হতাশাজনক। বিদেশি ফুটবলারদের ওপর নির্ভর করে দলগুলো শিরোপা জিতছে। পেশাদার লিগই এখন ঘরোয়া ফুটবলে সেরা আসর। ২০০৭ সালে এই লিগ মাঠে গড়ানোর সময় তৎকালীন বাফুফের সভাপতি এস এ সুলতান জোর গলায় বলেছিলেন পেশাদার লিগ দেশের ফুটবলের চেহারা বদলে দেবে। ২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, তিনি প্রফেশনাল লিগ এতটা জাঁকজমকভাবে আয়োজন করবেন যে দেশের ফুটবলের নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। এতে খেলার মান ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। দেখতে দেখতে তো এই আসর দশম মৌসুমে পা দিতে যাচ্ছে। কই দেশের ফুটবলে চেহারা বদলে গেছে কি? বরং অবনতি এমন এক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে ঘরোয়া ফুটবল ঘিরে দর্শকদের কোনো আগ্রহই নেই। রাত জেগে ইউরোপিয়ান লিগের খেলা দেখলেও দেশের গ্যালারি থাকছে শূন্য।

বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে সাবেক নন্দিত ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেছিলেন ফিফা বা এএফসি যতই গাইড লাইন দিক না কেন, পেশাদার লিগ বাংলাদেশে মানায় না। দেখবেন এতে করে দেশের ফুটবলে সর্বনাশ নেমে আসবে। ক্রিকেট সংগঠক হলেও টুটুলের পরিচয়তো মিলেছে ফুটবলার হিসেবেই। তাই তিনি বুঝতে পারছিলেন ভবিষ্যতে ফুটবলে কতটা করুণ দশা হতে পারে। এখন তো দেখছি তার ধারণা সত্য। আগে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে একটা প্রাণ ছিল। গ্যালারি থাকত ভরপুর। কিন্তু পেশাদার লিগের পর একি বেহাল দশা। দেশের আরেক সাবেক নন্দিত ফুটবলার ছাইদ হাসান কানন বলেন, বিশ্ব ফুটবলে এখন পেশাদারিত্বের যুগ। বাংলাদেশে তাই পেশাদার লিগ হবে এটাই স্বাভাবিক। ভারতেও তো এই লিগ হচ্ছে কিন্তু তাদের ফুটবলে কি হাহাকার চলছে? প্রশ্নটা উঠেছে বাংলাদেশে পেশাদার লিগে নিয়ম কানুন বা পেশাদারিত্ব নিয়ে। কটা ক্লাব পেশাদারিত্ব মানছে বলেন। পেশাদার লিগ অথচ এখানে তো ঢাকার ক্লাবগুলোর ছড়াছড়ি। ঢাকার বাইরে বড় জোর দুটো ক্লাব অংশ নিচ্ছে। ১০/১২ টা দল নিয়ে কি এই লিগ মানায়। আমরা যখন প্রিমিয়ার লিগ খেলতাম তখন ১৬ থেকে ২০টি দল অংশ নিত। ঢাকা লিগে যদি এত দল খেলতে পারে তাহলে পেশাদার লিগে সংখ্যা  কমবে কেন? আমি তো মনে করি অন্তত প্রত্যেক বিভাগের ১টি করে দল থাকা উচিত। তাহলে তো নিটল টাটা লিগই ভালো ছিল।

ভারতের ইন্ডিয়ান লিগেও গ্যালারিতে উপচে পড়া দর্শক হয় না। তারপরও তো জনপ্রিয়তা ও মান ঠিকই ধরে রেখেছে। এশিয়ান সেরা না হোক সাফ অঞ্চলে তো তারাই অপ্রতিরোধ্য। শিরোপা জেতা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর বাংলাদেশের সাফের সেমিফাইনাল খেলাটা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। দর্শক ধরে রাখতে ভারতে টুর্নামেন্টের শেষ নেই। ফ্রাঞ্চাইজি লিগ চালু করে এশিয়াতে সারা ফেলে দিয়েছে ভারত। বাফুফে কি করছে? ফেডারেশন কাপ ও পেশাদার লিগ নিয়মিত হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু নতুন কোনো টুর্নামেন্ট চালু করার উদ্যোগ নেই। আগে প্রেসিডেন্ট কাপ হতো জমজমাট। এই টুর্নামেন্টের অনেক আগেই বিলুপ্তি ঘটেছে। আগাখান গোল্ডকাপ ছিল ক্লাব ফুটবলে এশিয়ার অন্যতম সেরা আকর্ষণ। ১৯৮২ সালের পর এটাও শেষ। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ তাও অনিয়মিত। জাতির জনকের নামকরণে টুর্নামেন্ট। অথচ এটাকেও বিতর্কিত করে তুলেছে বাফুফে। নেপাল শেষ আসরে ট্রফি জিতলেও প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের প্রাইজমানি দেওয়া হয়নি। গত বছর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শিডিউল থাকলেও পরবর্তী আসর মাঠে গড়াবে কিনা এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সব কিছুতেই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। দর্শক তো আর এমনিতেই মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।

সালাউদ্দিন সভাপতি হওয়ার পর পরই ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন ফুটবলে নতুন টুর্নামেন্ট সুপার কাপ মাঠে নামিয়ে। ২০০৯ সালে মাঠে গড়ায় সুপার কাপ। চ্যাম্পিয়ন দল পাবে ১ কোটি টাকার প্রাইজমানি। দক্ষিণ এশিয়া ফুটবলে যা ছিল নতুন এক ইতিহাস। প্রথম আসরেই সুপার কাপ সুপারহিট। মাত্র ৮টি দল অংশ নিলেও সুপার কাপ দেশের ফুটবলকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। ফাইনালে চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ দেখতে শুধু গ্যালারিই ভরে যায়নি। টিকিট না পেয়ে হাজারও দর্শক বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বাইরে হতাশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফাইনালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও গ্যালারি ভরা দর্শক দেখে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, বাংলার মানুষ ফুটবলকে কতটা যে ভালোবাসে সুপার কাপই প্রমাণ করে দিয়েছে। ফুটবলে প্রাণ ফিরে আসায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া সুপার কাপ ঘিরে বিশেষ টক শো করে। অনেক প্রিন্ট মিডিয়া লিড নিউজও করেছিল। অথচ এমন জনপ্রিয় আসর শেষ হয়ে গেল মাত্র তিন আয়োজনেই। ফুটবল দর্শক আসা শুরু করেছিল। কিন্তু আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট না হওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

প্রথম আসর মাঠে নামার আগে সালাউদ্দিন দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন সামনে সুপার কাপ আরও জমজমাট হবে। প্রাইজমানি বাড়ানো ছাড়াও বিদেশি দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কিন্তু কোথায় কী, তিন আসরেই শেষ। ফান্ডের কারণে নাকি সুপার কাপের বিলুপ্তি ঘটেছে। অথচ নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা লাখ লাখ টাকা উড়ায়। ফুটবলে মান ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে বাফুফের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। শুধু প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়। বাস্তবে তা অদৃশই থেকে যাচ্ছে।

ফুটবল এখনো যে বেঁচে আছে এর পেছনে বাফুফের কোনো ভূমিকা নেই। শেখ রাসেল, শেখ জামাল, ঢাকা আবাহনী, ঢাকা মোহামেডানসহ অন্য ক্লাবগুলো এমন দুর্দিনেও কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে বলে পেশাদার লিগ মাঠে নামছে। তা না হলে বাফুফে সাইন বোর্ড সর্বস্ব ফেডারেশনে পরিণত হতো। এ থেকে পরিত্রাণের কি উপায় নেই? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

সর্বশেষ খবর