শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ফুটবল লিগে ৬৯ বছর

সেকালের মাকরানী একালের আফ্রিকান

ক্রীড়া প্রতিবেদক

সেকালের মাকরানী একালের আফ্রিকান

৬৯ বছরের ঢাকা ফুটবল লিগ ইতিহাসে অনেক দল অংশ নিলেও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের সাফল্য ঈর্শ্বনীয়। ফুটবলে অধিকাংশ ট্রফি তাদেরই ঘরে —ফাইল ফটো

ঘরোয়া ফুটবলে এখন কোনো প্রাণ না থাকলেও এক সময়ে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। ১৯৪৮ সালে অভিষেক ঢাকা ফুটবলের। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কোনো বিভাগে ভাগ ছিল না ঘরোয়া ফুটবল। এক লিগ হতো ঢাকা লিগ। তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামের চেহারা তো এত জৌলুস ছিল না। কাঠের গ্যালারিতে বড় জোর ৩ কিংবা ৪ হাজার দর্শক খেলা উপভোগ করতে পারতেন। বাংলাদেশের ফুটবল মানেই তো ঢাকা মোহামেডান-ঢাকা আবাহনীকে বোঝায়। অথচ প্রথম দিকে লিগে অন্যান্য ক্লাবের দাপট ছিল তুঙ্গে। ফুটবলে এখন তো ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কোনো নাম গন্ধ নেই। অথচ ঢাকা লিগে প্রথম শিরোপা জেতা কৃতিত্ব তাদের। সর্বমোট তিনবার লিগ জেতার কৃতিত্ব রয়েছে তাদের। ওই সময়ে জনপ্রিয় দল ছিল ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স ও ওয়ারী। মূলত হিন্দু ফুটবলারদের নিয়েই দল গড়তো তারা। সবচেয়ে বড় বাজেটে দল গড়তো ওয়ান্ডারার্স। ৫০-৬০ দশক ছিল ওয়ান্ডারার্সের স্বর্ণযুগ। ১৯৫০ সালে শুরু আর ষাটে শেষ। এরই ভিতরে সর্বোচ্চ ছয়বার লিগ জেতার রেকর্ড ছিল তাদের। ৬০ সালের পর আর শিরোপার মুখ দেখতে পারেনি।

ঢাকা মোহামেডান। যে ক্লাবকে উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বলা হয়। ঢাকা লিগে তাদের প্রথম শিরোপা জয় ১৯৫৭ সালে। এখন যেমন মোহামেডান-আবাহনী। ৫০ আর ৬০ দশক পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্স ও মোহামেডান ছিল একে অপরের প্রধান প্রতিপক্ষ। দুই দলের খেলা মানেই গ্যালারি ভরে যাওয়া। ১৯৬৬ সালে শিরোপা জিতে ওয়ান্ডারার্সের রেকর্ড স্পর্শ করে ফেলে মোহামেডান। ৬৯ সালে সবাইকে পেছনে ফেলে মোহামেডান সপ্তমবারের মতো লিগ জিতে নেয়। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক মৌসুম ধরে রাখলেও শিরোপা জিততে না পারায় ওয়ান্ডারার্স সেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম বিভাগ লিগে অভিষেক হয় ঢাকা আবাহনী ক্রীড়া চক্রের। শুরুতেই তারা তারকানির্ভর দল গড়ে ক্রীড়াঙ্গনে আলোড়ন তুলে। এটা আবার ঢাকার অন্য দলগুলো মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রথম কয়েক মৌসুম গ্যালারিতে আবাহনীর সাপোর্টার দেখা যায়নি। ১৯৭৫ সাল থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। মোহামেডানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দল বনে যায় আবাহনী। ইংল্যান্ডে যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল, স্পেনে বার্সা-রিয়াল। বাংলাদেশে আবাহনী-মোহামেডান। মোহামেডানের প্রায় ৪০ বছর পর আবাহনীর সৃষ্টি। অথচ বাংলাদেশের ফুটবলে তারাই এখন সেরা দল। পেশাদারসহ সর্বোচ্চ ১৬ বার লিগ জেতার রেকর্ড রয়েছে তাদের। মোহামেডান সেখানে কি না ১২ বার লিগ জিতেছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে ঢাকার মাঠে পশ্চিম পাকিস্তানি ফুটবলারদের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৫৯ সালে অফিস দলে পিডব্লিউডিতে ইমাম বক্স নামে প্রথম মাকরানী ঢাকায় খেলতে আসেন। এরপর ৭০ পর্যন্ত কত যে পশ্চিম পাকিস্তানি ঢাকা লিগে খেলেছেন তার হিসাব মেলানো মুশকিল। তবে ওমর, আবিদ, জব্বার, মওলা বক্স কালো গফুর, গফুর বেলুচ, কাদের বক্স, আমির বক্স, আবদুল্লাহ, মুসা, আয়ুবদার, আলী নেওয়াজ, ইদ্রিস এদের নৈপুণ্য এখনো চোখে ভাসে। স্বাধীনতার পর ঢাকা ফুটবল লিগে প্রথম বিদেশির আগমন ঘটে ১৯৭৪ সালে। ভারতের শ্রীপ্রসাদ, প্রবাদ মিশ্র নামে দুই ফুটবলার অংশ নেয় ঢাকা মোহামেডানে। ৭৫, ৭৬ গ্যাপ থাকলেও ৭৭ থেকে নিয়মিতভাবে বিদেশিরাই ঢাকা লিগে অংশ নিচ্ছেন। নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকায় উন্নতমানের বিদেশিরা অংশ নিতেন। পাকির আলী, নালজেগার, এমেকা, বিজন তাহেরী, ঝকভ, পলিন কভ, সামির সাকি, করিম মোহাম্মদ, রহিমতদের খেলা এখনো ভোলবার নয়।

১৯৪৮ থেকে ২০১৭। উনসত্তরের বছরে পা দিয়েছে ঢাকার ফুটবল। অবশ্য ২০০৭’র পর একে ঢাকা লিগ বলাটা বেমানানই হবে। ওই বছর থেকে লিগ পেশাদারিত্বে পা দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লাব ঢাকার বলে পেশাদার লিগকেও ঢাকা লিগ বললেও ভুল হবে না। সেকালের মাকরানী একালের লিগে আফ্রিকানদের ছড়াছড়ি। এখন যতই ম্লান থাকুক না কেন ঢাকা লিগের স্মৃতি ভোলবার নয়। জাকারিয়া পিন্টু, গোলাম সারোয়ার টিপু, প্রতাপ শংকর হাজরা, শহিদুর রহমান সান্টু, কাজী সালাউদ্দিন, মো. হাফিজ উদ্দিন, কায়কোবাদ, মনোয়ার হোসেন নান্নু, শামসুল আলম মঞ্জু, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, ছোট নাজির, এনায়েত, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, শেখ মো. আসলাম, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রুমি, খোরশেদ বাবুল, জনি, কানন, সাব্বির তারকার খ্যতি পেয়েছেন অনেকেই।

এক সময়ে ঢাকা ফুটবলে প্রাণ ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ক্লাবগুলো দল গড়লেও ফেডারেশনের নিস্তেজ ভূমিকায় লিগের জনপ্রিয়তা শূন্যতে নেমে এসেছে। বিনা টিকিটেও দর্শকরা এখন মাঠে আসতে চান না। পেশাদার লিগে আকর্ষণ থাকবে অন্যরকম। ফুটবল ছড়িয়ে যাবে গোটা দেশে। কিন্তু সামনে নয়, এই লিগের যাত্রার পরই দেশের ফুটবল যেন পেছনেই হাঁটছে। ৬৯ বছরে কত স্মৃতিই না ভাসে। এখন ফুটবল মানে যেন হতাশা আর বিরক্তি। এই অবস্থার পরিবর্তন কি ঘটবে না।

সর্বশেষ খবর