সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুশফিকের বীরত্বের দিনে ব্যর্থ বোলাররা

আসিফ ইকবাল

মুশফিকের বীরত্বের দিনে ব্যর্থ বোলাররা

সেঞ্চুরির পর মুশফিককে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এলেন নাসির হোসেন। মুশফিকই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করলেন —এএফপি

গ্রিক বীর অ্যাকিলেসের বীরত্বের সঙ্গে তুলনায় আসতেই পারেন মুশফিকুর রহিম! সুন্দরী হেলেনকে গ্রিস থেকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে সুরক্ষিত ট্রয় নগরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজপুত্র প্যারিস। গ্রিকরা এটা মেনে নিতে পারেননি। যুদ্ধ ঘোষণা করে ট্রয়ের বিপক্ষে এবং ১০ বছরের যুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন অ্যাকিলিস, তার ফল পেয়েছিল গ্রিকরা। জয় করেছিল ট্রয়। ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল হেলেনকে। অ্যাকিলিস দুঃসাহসী যুদ্ধ করে জবাব দিয়েছিলেন হেক্টর, মেনোলিসদের মতো বীর যোদ্ধাদের। গতকাল ‘হীরকের শহর’ কিম্বার্লিতে সমালোচকদের হাজারও সমালোচনার জবাব দেন মুশফিক একইভাবে বীরত্বপূর্ণ এক সেঞ্চুরিতে। ১৭৭ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে যা পঞ্চম সেঞ্চুরি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রথম। কিন্তু এর মাহাত্ম্য, আবেদন ও জবাব অসাধারণ। হাজারও সমালোচনা জয় করা অবিশ্বাস্য এক সেঞ্চুরি এটা। হিমালয়সম চাপের মুখে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিক এমন এক সেঞ্চুরি করেন, যাতে তিনি শুধু নিজে ভারমুক্ত হননি, ভিক্টেরিয়া হ্রদে হাবুডুবু খাওয়া বাংলাদেশকেও ভারমুক্ত করেন। তবে মুশফিকের সেঞ্চুরির ম্যাচে বাংলাদেশকে ১০ উইকেটের বড় হার উপহার দিলেন দুই প্রোটিয়া সেঞ্চুরিয়ান নাথান ডি কক ও হাশিম আমলা। মুশফিকের বীরত্ব ম্লান হয়ে গেল বাংলাদেশের বোলারদের ব্যর্থতায়।

সমালোচনার খাপখোলা তলোয়াড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটার, অধিনায়করা এফোড়-ওফোড় হচ্ছেন নিত্য। মুশফিক এবার যেভাবে সমালোচনার তীর্যকবাণে বিদ্ধ হয়েছেন, তাতে মানসিকভাবে টিকে থাকাই ছিল কঠিন। পচেফস্ট্রুুম ও ব্লুমফন্টেইনের ব্যাটিং উইকেটে টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ায় সমালোচকরা তাকে শূলে চড়ানোর রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজের সঙ্গে লড়াই করে অধিনায়কত্ব না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং জয়ীও হন। ব্রাভো মুশফিক!

পচেফস্ট্রুম ও ব্লুমফন্টেইনের ধারাবাহিকতায় কিম্বার্লিতেও টস জিতে বাংলাদেশ। খেলতে নামে নিয়মিত একাদশের তিন সৈনিক ছাড়া। ইনজ্যুরির জন্য তামিম ইকবাল ও মুস্তাফিজুর রহমান এবং ‘আউট অফ ফর্ম’ সৌম্য সরকারকে বাইরে রেখে খেলতে নামে মাশরাফি বাহিনী। ইমরুল কায়েসের সঙ্গে ওপেন করেন লিটন দাস। দুজনে ৫৩ বলে ৪৩ রানের ভিত দেন দলকে। যাতে চড়ে ৫০ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৭ উইকেটে ২৭৮ রান। এরমধ্যে ৫ হাজার রান ও ২০০ উইকেট নেওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখান রেকর্ডের ‘বরপুত্র’ সাকিব আল হাসান। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে ৩৬ ওভার ক্রিজে থেকে ১১০ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন মুশফিক। ১১৫ বলে ১১ চারে সাজানো ইনিংসটি অনেকটাই যেন ইটের জবাবে পাথর মারা! টেস্ট সিরিজে ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ গতকাল ব্যাটিং করে ব্যাটিং অর্ডারে ব্যাপক রদবদল করে। দীর্ঘদিন পর ওয়ান ডাউনে ব্যাটিং করেন সাকিব। খেলেন ৪৫ বলে ২৯ রানের প্রত্যয়ী ইনিংস। ইনিংসটি খেলার পথে ১৭৮ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বিশ্বের পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে সনত জয়সুরিয়া, জ্যাক ক্যালিস, শহীদ আফ্র্রিদি ও আব্দুল রাজ্জাকের পর ৫ হাজার রান ও ২০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েন। ফর্মে ফেরার লড়াইয়ে ব্যস্ত ইমরুল খেলেন ৩১ রানের ইনিংস। লিটন করেন ২১ রান। ৬৭ রানে দুই ওপেনারের বিদায়ের পর দলের দুই ব্যাটিং কাণ্ডারী সাকিব ও মুশফিক জুটি বেধে যোগ করেন ৫৯ রান। সাকিবের বিদায়ের পর মুশফিক জুটি বাধেন ব্যাটিং শিল্পী মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে। দুজনে চতুর্থ উইকেট জুটিতে যোগ করেন ৬৯ রান। ভালো খেলতে থাকা মাহমমুদুল্লাহ ফিরে যান ব্যক্তিগত ২৬ রানে। কিন্তু থেমে থাকেননি মুশফিক। সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন, অভিষিক্ত মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনদের নিয়ে প্রোটিয়া বোলারদের সব আক্রমণকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে তুলে নেন ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির পর যে উচ্ছ্বাস দেখা যেত মুশফিকের, কাল সেটার ছিটোফোঁটা ছিল না। এমন বীরত্বগাথা সেঞ্চুরি পর হেলমেট খুলে মহান রাব্বুল আল-আমিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এরপর কৃতজ্ঞতায় চুমু খান মাটিতে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হলেও লড়াইয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ফুটেছিল অবয়বে। এভাবেই মুশফিক জবাব দেন। দিয়েছেন এর আগেও। কিন্তু কিম্বার্লীর জবাবটা যেন অনেকবেশি কঠোর! সমালোচনার জবাব দেওয়া মুশফিকের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ আড়াইশোর্ধ্ব ইনিংস খেলল আবার। যা প্রোটিয়াদের বিপক্ষে দ্বিতীয় এবং সর্বোচ্চ দলগত ইনিংস। ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে গায়ানার প্রোভিডেন্স পার্কে ৮ উইকেটে ২৫১ রান করেছিল বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে খেলেছিলেন মুশফিক এবং জিতেছিল টাইগাররা। এবার মুশফিকের সেঞ্চুরিতে ২৭৮ রান শুধু দলগত নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও সর্বোচ্চ স্কোর বাংলাদেশের।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ : ২৭৮/৭, ৫০ ওভার (মুশফিক ১১০*)

দ. আফ্রিকা : ২৮২/০, ৪২.৫ ওভার (কক ১৬৮*, আমলা ১১০*)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর