রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিজ ঘরে পরবাসী টাইগাররা

মেজবাহ্-উল-হক

নিজ ঘরে পরবাসী টাইগাররা

আড়াই দিনেই শেষ মিরপুর টেস্ট। ম্যাচ হেরে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ছেন মুস্তাফিজুর রহমান ও তাইজুল ইসলাম। দুই ক্রিকেটারের এই দৃশ্যই ছিল গতকাল টেস্টের প্রতিচ্ছবি।- রোহেত রাজীব

‘কী আছে হোথায়, চলেছি কিসের

অন্বেষণে?

বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়

অপরিচিতা!’

-কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সোনার তরী’ কাব্য গ্রন্থের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় এই প্রশ্নটি রেখেছিলেন! গতকাল সংবাদ সম্মেলন থেকে মাঠের ভিতর দিয়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার সময় টাইগার ক্যাপ্টেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন বার বার উইকেটের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তার মনেও কি এমন প্রশ্ন জাগছিল?

কী আছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটে। যেখানে দুই ইনিংসেই ব্যাটিং ধস হলো বাংলাদেশের। প্রথম ইনিংসে ১১০ রানে অলআউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে স্বাগতিকরা গুটিয়ে গেল মাত্র ১২৩ রানেই। অথচ আগের টেস্টে চট্টগ্রামে ব্যাটিং দাপট দেখিয়ে নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচেও ড্র করেছিল বাংলাদেশ। আর ঢাকায় ব্যাটিং ধসেই হয়ে গেল সর্বনাশ!

‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম! এই উইকেট তো মাহমুদল্লাহদের কাছে অপরিচিত নয়! বরং এখানকার সব কিছু তার কাছে হাতের তালুর মতো চেনা।  এখানেই সব সময় অনুশীলন করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। তারপরও এই মাঠেই কিনা টাইগাররা অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হলো। সোয়া দুই দিনেই হেরে গেল বাংলাদেশ। সেটাও কিনা ২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে। নিজের ঘরেই যেন পরবাসী হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।

চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র হওয়ার পর ঢাকায় জয়ের কথা চিন্তা করেছিল বাংলাদেশ। তাই বানানো হয়েছিল স্পিন সহায়ক উইকেট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের পরিকল্পনাই তো বুমেরাং হয়ে গেল। এই উইকেট থেকে শতভাগ সুবিধা আদায় করে নিয়ে বাংলাদেশকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল শ্রীলঙ্কা। উইকেটে বল স্লো হচ্ছে, লো হচ্ছে। আবার হঠাৎ হঠাৎ বল উঠে যাচ্ছে। উইকেটের সুবিধা নিয়ে লঙ্কান স্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়া তার অভিষেক ম্যাচেই ২৪ রানে তুলে নিলেন ৫ উইকেট। হেরাথ পেয়েছেন ৪ উইকেট। গতকাল উইকেটে গিয়ে টিকতেই পারছিলেন না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ডিফেন্স করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিচ্ছেন। হাত খুলে খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসছেন। বাইশগজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল- যেন চোখ বেঁধে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আমাজনের গহিন জঙ্গলে!

এই লজ্জার জন্য কি উইকেট দায়ী নাকি ব্যাটিং ব্যর্থতা? টাইগার ক্যাপ্টেনের দাবি, তারা জানতেন মিরপুরে স্পিন নির্ভর উইকেট হবে। এখানে টেস্টের ফল হবে। কিন্তু সতীর্থরা যে এতটা খারাপ করবে তা বুঝতে পারেননি। তাই এমন লজ্জার হারের ব্যাখ্যা নেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কাছে, ‘জবাব দেওয়া আসলে কঠিন। কারণ, এই হার অবশ্যই খুব হতাশাজনক। এ ধরনের উইকেটে আমরা জানতাম হয়তো টার্গেট চেজ করতে হবে। আর মোটামুটি আমাদের সবারই ধারণা ছিল যে এই টেস্টে আমরা রেজাল্ট দেখব। আমরা জানি, স্পিনসহায়ক উইকেট। প্রথম ইনিংসেই আমাদের ভালো করা উচিত ছিল। আমার মনে হয় এই জিনিসটা আমরা পিছিয়ে গেছি। প্রথম ইনিংসে যদি আমরা ২০০ বা তার বেশি করতে পারতাম তাহলে হয়তো আমাদের আরেকটু ভালো সুযোগ ছিল। কারণ এই উইকেটে হয়তো বা ৩৪০, চেজ করা কিছুটা অবশ্যই অতিরিক্ত চাপ ছিল।’

জয়ের জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৩৩৯ রান। টাইগাররা গুটিয়ে যায় মাত্র ১২৩ রানেই। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ব্যাটসম্যানদের ওপর ভরসা করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ক্যাপ্টেনের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারেননি। মাহমুদুল্লাহ বলেন, ‘ক্রিকেট খেলা তো একটা বাজির মতো। আমরা জানতাম যে ওদের স্পিন ডিপার্টমেন্টটা খুব ভালো। আর আমাদের স্পিন ডিপার্টমেন্টও ব্যাক করেছিল। জানতাম আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্যও চ্যালেঞ্জিং হবে কিন্তু আমরা আমাদের ব্যাটসম্যানদের উপর ভরসা রেখেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ব্যাটসম্যানরা ভালো পারফর্ম করতে পারেনি।’ গতকাল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা শুরু থেকেই মারমুখী হয়েছিল। যে কারণে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন। অথচ এমন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ব্যাটিং করার কথা। এক্ষেত্রে মাহমুদুল্লাহ ব্যাটসম্যানদের পক্ষ নেন, ‘আপনি যদি মনে করেন আপনি ডিফেন্সিভ খেলবেন, ইউ কান্ট প্লে ডিফেন্সিভ ইন দিস উইকেট। আমার মনে হয় না। আমার যা জ্ঞান, আমার যা অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় না যে এই ধরনের উইকেটে আপনি ডিফেন্স করতেই থাকবেন। কারণ বোলার ছয়টা বল করবে, সাত নম্বর বলে আপনাকে সুন্দর মতো সিলিতে অথবা স্লিপে নিয়ে যাবে। আর আপনাকে স্ট্রোক খেলতে হবে।’

ঢাকায় বাংলাদেশের হারের জন্য নিজের ‘দুর্বল’ কৌশলই দায়ী। সুপরিকল্পনার অভাবেই হারতে হলো। তাই লজ্জার এই হারের পর হয়তো মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের মনে পার্থ বড়ুয়ার সেই গানটাই উঁকি দিচ্ছে-‘সারাদিন তোমায় ভেবে হলো না আমার কোন কাজ হলো না তোমাকে পাওয়া দিন যে বৃথাই গেল আজ!’

সংক্ষিপ্ত স্কোর

শ্রীলঙ্কা : প্রথম ইনিংস ২২২/১০ ও দ্বিতীয় ইনিংস ২২৬/১০ (তাইজুল ৪/৭৬)

বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস  ১১০/১০ ও দ্বিতীয় ইনিংস ১২৩/১০, ২৯.৩ ওভার (মুমিনুল ৩৩, মুশফিক ২৫। হেরাথ ৪/৪৯, ধনাঞ্জয়া ৫/২৪)

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর