শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

যেখানে হার মেনেছিল রূপকথাও

পোস্ট ছেড়ে গোলরক্ষক উধাও!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

যেখানে হার মেনেছিল রূপকথাও

ফুটবলের সেই মানিক জোড় মহসিন (বাঁয়ে) ও বাবলু

ম্যাচ চলছে। অথচ পোস্ট ছেড়ে গোলরক্ষক উধাও। সতীর্থরা বার বার ডাকা সত্ত্বেও মাঠে ফিরছেন না তিনি। ফুটবলে এই ধরনের ঘটনা অবিশ্বাস্যই মনে হবে। অথচ বাস্তবে এই দৃশ্য চোখে পড়েছিল ১৯৭৩ সালে। তাও আবার ঢাকা ঘরোয়া ফুটবলে। গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ওই সময় প্রথম বিভাগে না খেললেও তাদের নাম বা খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তত্কালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগ লিগ চলছে। অথচ দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় ছিল আউটার স্টেডিয়ামে। কেননা, তৃতীয় বিভাগ লিগে প্রতিটি ম্যাচেই ম্যাজিক প্রদর্শন করত ব্রাদার্স।

গোলের পর গোল করে প্রতিপক্ষদের দাঁড়াতেই দিত না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৯ গোলে জেতার রেকর্ড রয়েছে তাদের। শুধু তাই নয় ১৫, ১৬, ১২, ১০ ও ৯ গোলে জেতাটা ব্রাদার্সের কাছে ছিল মামুলি ব্যাপার। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সেবার তৃতীয় বিভাগ লিগে ১৭ ম্যাচে গোপীবাগের দলটির গোলের সংখ্যা ১৪৫টি। যা রূপকথাকেও হার মানিয়েছিল। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই ব্রাদার্স দ্বিতীয় বিভাগে উঠেছিল। ব্রাদার্সের এমন জাদুকরি ফুটবল দেখতে শুধু দর্শক নয়, ছুটে যেতেন জাকারিয়া পিন্টু, শহিদুর রহমান শান্টু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতদের মতো তারকা ফুটবলাররাও। তারা মুগ্ধ হয়ে যেতেন দলটির নৈপুণ্য দেখে।

বাংলাদেশ তো বটে, তৃতীয় ও দ্বিতীয় বিভাগ মিলিয়ে সেই সময় ব্রাদার্স যে গোল করেছে সেই রেকর্ড উপমহাদেশের কোনো ঘরোয়া আসরে নেই। অধিকাংশ ফুটবলারই তখন স্কুল পার করেননি। তারপরও জুনিয়র লিগে এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স প্রদর্শন করল কিভাবে? এর পেছনে রহস্যটা কি? ফুটবল ১১ জনের খেলা হলেও দুটি নাম তখন ক্রীড়ামোদীদের মুখে মুখে। স্ট্রাইকার মো. মহসিন ও রাইট আউট হাসানুজ্জামান খান বাবলু। যাদেরকে মানিকজোড় বলেই ডাকা হতো। তৃতীয় বিভাগে মহসিন ছিলেন গোলের মেশিন। পায়ে বল আসলেই কথা নেই সরাসরি দুর্দান্ত শটে জালে পাঠাতেন।

এক ম্যাচের কথা বলি। মাঠে ব্রাদার্সের প্রতিপক্ষ হয়ে নেমেছিল দয়াগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব। হাসানুজ্জামান খান বাবলু বল জোগান দিচ্ছেন আর মহসিন একের পর এক গোল করে যাচ্ছেন। তখন তৃতীয় বিভাগে খেলা ৮০ মিনিট। অথচ ২৫ মিনিটের মধ্যেই চার গোল করে ফেলেন মহসিন। প্রতিটি শট যেন ছিল বুলেটের মতো গতিময়। পঞ্চম গোলের আগে মহসিনের পায়ে বল দেখেই দয়াগঞ্জের গোলরক্ষক পোস্ট ছেড়ে বাইরে দর্শকদের সঙ্গে মিশে যান। রেফারি খেলা থামিয়েও দেন। কিন্তু গোলরক্ষককে বার বার সতীর্থরা ফিরে আসার আহ্বান জানালেও হাত নাড়িয়ে তিনি না করছিলেন। বললেন, মহসিনের শট ঠেকাতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। পরে দয়াগঞ্জ গোলরক্ষক বদল করতে বাধ্য হয়। ম্যাচও শুরু হয়, মহসিনের ট্রিপল হ্যাটট্রিকসহ ওই ম্যাচে ব্রাদার্স জিতে  ১০-০ গোলে।

শুধু একটি নয়, দুটি ট্রিপল, দুটি ডাবল ও তিনটি হ্যাটট্রিকসহ লিগে মোহসিন সর্বোচ্চ ৪২টি গোল করেন। যা এক ইতিহাসই বলা যায়। স্মৃতিচারণ করে মহসিন বললেন, ‘অনেকের সহযোগিতায় এত গোল করেছি। তবে বাবলুর সহযোগিতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করব। ও যেভাবে বল জোগান দিত, তাতে আমার পক্ষে গোল করাটা কোনো কষ্টকর হতো না। আসলে মাঠে আমাদের বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ।’ বাবলু বলেন, ‘মহসিন ছিলেন আমাদের সুপারস্টার। আর আমরা জোগানদাতা। ওর কাছে বল পাঠালেই হতো শট বা নিখুঁত হেডে গোল করত। তৃতীয় বিভাগে আমারও বেশ কটি হ্যাটট্রিক আছে। অন্যরাও গোল করেছে। কিন্তু মহসিনের প্রতিটি গোলই ছিল দেখার মতো।’

১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগ লিগেও গোল উত্সবে মেতেছিল ব্রাদার্স। তবে তৃতীয় বিভাগের মতো নয়। সর্বোচ্চ ১০ গোলের রেকর্ড ছিল। ৯ ও ৬ গোলে জিতেছে বেশ কটি ম্যাচে। এখানেও ছিল মহসিন-বাবলুর ক্যারিশমা। ট্রিপল না হলেও মহসিন দুই ম্যাচে ডাবল হ্যাটট্রিক করেন। হন সর্বোচ্চ গোলদাতা। বাবলুর ছিল দুটো হ্যাটট্রিক।

ফাইনাল ম্যাচে স্মৃতিচারণ করে বাবলু বললেন, ‘যারা জিতবে তারাই স্বপ্নের প্রথম বিভাগে উঠে যাবে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল। চিন্তায় ছিলাম ম্যাচে কি হবে? মাঠে নামার পর দেখলাম ওরা পাত্তাই পাচ্ছে না। প্রথমার্ধেই ৪-০ গোলে এগিয়ে যায়। গোপীবাগ ও ফকিরেরপুল পাশাপাশি দুই মহল্লার লড়াই ছিল বলে ম্যাচটি তত্কালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। মনজুর হাসান মালু ভাই তখন ফকিরেরপুলে খেলতেন। দ্বিতীয়ার্ধে কিছুক্ষণ চলার পরই দেখলাম তারা আর খেলতে চাচ্ছে না। ফকিরেরপুলের এক কর্মকর্তা এসে বললেন, আমরা হার মেনে নিয়েছি। ব্রাদার্সকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করুন। ব্যস্ আমরা উঠে গেলাম প্রথম বিভাগে।’ বাবলু ও মহসিন দুজন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন প্রয়াত কোচ গফুর বেলুচের অবদানের কথা। ‘ওস্তাদ ছিলেন আমাদের বাবার মতো। তার যোগ্য প্রশিক্ষণে ব্রাদার্স আজ এই পর্যায়ে এসেছে।  শুধু ব্রাদার্স নয় বাংলাদেশে ফুটবলে তার নামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ১৯৭৫ সালে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত করল ব্রাদার্স। তারকা ভরা চ্যাম্পিয়ন আবাহনীকে হারিয়ে তারা চমক সৃষ্টি করে। কালের বিবর্তনে ব্রাদার্স এখন আগের অবস্থানে নেই। কিন্তু ৭০ ও ৮০ দশকে যে খেলা খেলেছিল তা যেন রূপকথাকেও হার মানিয়ে ছিল।

সেই সময়কার গৌরবই ব্রাদার্স ইউনিয়নের এখন বড় সম্পদ। বাংলাদেশে অসংখ্য তারকা ফুটবলারের দেখা মিলেছে    এই ক্লাব থেকে। মহসিন, বাবলু, সেলিম,   নান্নু, বাবুল, শরীফ, টুকু, মিন্নু, ওয়াসিম— এদের পারফরম্যান্স এখনো চোখে ভাসে।

সর্বশেষ খবর