সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

রূপকথা লেখা হলো না ক্রোয়েশিয়ার

আসিফ ইকবাল

রূপকথা লেখা হলো না ক্রোয়েশিয়ার

হারকিউলিস হয়ে উঠতে পারলেন না লুকা মডরিচ! গ্রিক উপাখ্যানের ‘মহান বীর’ হারকিউলিস সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে মহাবিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেছিলেন মানব জাতিকে। গ্রিক বীরের দেখানো পথেই হাঁটছিলেন ক্রোয়াট বীর। হারকিউলিস জয় করেছিলেন বিশ্ব। মডরিচ চেয়েছিলেন বিশ্বকাপের বহু আরাধ্য সোনালি ট্রফি মস্কোর বৃষ্টিভেজা আকাশে তুলে ধরতে। পারেননি। বিরস নয়নে, কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখেছেন গ্রিজম্যান, পগবা, এমবাপ্পেদের প্রজাপতির হাজার রঙের পাখায় চড়ে ভেসে বেড়াতে। দেখেছেন মস্কোর রাতের আকাশকে ফরাসি সৌরভে আলোয় আলোকিত হতে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাশিয়ার মাটিতে ক্রোয়েশিয়ার রূপকথা লিখতে চেয়েছিলেন মডরিচ তার সতীর্থ রাকিতিচ, পেরিসিচ, সুবাসিচদের নিয়ে। ফরাসি মাপ-জোকের ফুটবলের কাছে হেরে রূপকথা লেখা হয়নি ক্রোয়াট বীরদের। কিন্তু মনের গহিনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন ক্রোয়াট জাতির।

মহাকাব্যের ফাইনালে ক্রোয়াট বীর মডরিচরা নেমেছিলেন আবেগকে সঙ্গী করে। সাহস জুগিয়েছিল ইতিহাসও। কিন্তু বাস্তব যে অনেক বেশি রুক্ষ, সেটা ম্যাচে নেমে টের পেয়েছেন ক্রোয়াট বীররা। বিশ্বসেরা হতে শুধু আবেগ দিয়ে ফুটবল খেললেই হয় না। সঙ্গে ভাগ্যও দরকার। সেই ভাগ্যটাই যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্রোয়েশিয়ার সামনে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আত্মঘাতী গোল ও ভিআর পদ্ধতিতে পেনাল্টিই বলে ভাগ্য সহায় করেনি ক্রোয়াটদের। অবশ্য ফাইনালে দুর্দান্ত খেলে এসেছিল ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটি। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার মতো পরাক্রমশালী দলকে পেছনে ফেলে জায়গা নেয় নকআউট পর্বে। ওই ম্যাচে প্রতিবেশী ডেনমার্কের সঙ্গে সমানে সমান ১২০ মিনিট লড়াই করে টাইব্রেকারে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেরা আটের কঠিন ব্যারিয়ারও মডরিচদের টপকাতে হয় টাইব্রেকারে। সেমিফাইনালে টাইব্রেকার না হলেও ইংল্যান্ডকে হারাতে ১২০ মিনিট ক্লান্তিহীন ফুটবল খেলতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। টানা তিন ম্যাচে ১২০ মিনিট খেলার রেকর্ডকে সঙ্গী করে গতকাল যখন লুঝনিকি স্টেডিয়ামে খেলতে নামে মাত্র ৪২ লাখ জনসংখ্যার রাষ্ট্রটি, তখন ইতিহাসের অদ্ভুত ফর্মুলা আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল রূপকথা লিখতে। অদ্ভুত ফর্মুলার এই ইতিহাস বলছিল ২০ বছর পরপর নতুন একটি চ্যাম্পিয়নে দেখা পায় বিশ্ব। ১৯৩৪ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইতালি। চার বছর পর ১৯৩৮ সালেও বিশ্বসেরা হয় দেশটি। এর ২০ বছর পর ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে ধরে ব্রাজিল। তার ২০ বছর পর ১৯৭৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার দেশের সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ জয়। এরপর ফ্রান্স প্রথম বিশ্বকাপ জয় করে ১৯৯৮ সালে। ইতিহাসের অদ্ভুত এই ফরম্যাটই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল মডরিচদের রূপকথা লেখার। কিন্তু বাস্তবতা যে অনেক বেশি কঠিন, সেটা ক্রোয়াটদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিলেন গ্রিজম্যান, পগবা, এমবাপ্পেরা দ্রুতগতির, কাঁটা-কম্পাসের ফুটবল খেলে। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে জন্ম ক্রোয়েশিয়ার। জন্ম কিন্তু স্বাভাবিক পথে আসেনি। প্রতিবেশী সার্বিয়ার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা পায়। স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বিশ্বকাপ খেলে সাত বছর পর ১৯৯৮ সালে। ফ্রান্স বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নেমেই বাজিমাত করে। ডেভর সুকারদের উদ্দীপ্ত ফুটবলে ক্রোয়েশিয়া জায়গা করে নেয় সেমিফাইনালে। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ১-২ গোলে হেরে গিয়েছিল ফ্রান্সের কাছে। ২০ বছর পর রূপকথা লেখার দিনের ম্যাচটি আবার ছিল প্রতিশোধেরও। দুই দশক আগের ম্যাচ হারার প্রতিশোধ নিতে পারলেও রূপকথাও লেখা হতো মডরিচদের। কিন্তু প্রতিশোধের ম্যাচটি জিততে পারেনি ক্রোয়াট বীররা। স্বপ্নের ফাইনাল হেরে লিখতে পারেনি রূপকথাও।

রূপকথা লেখা হয়নি মডরিচদের। রাশিয়া বিশ্বকাপে মডরিচ, রাকিটিচ, ভিদা, সুবাচিচরা কিন্তু সবাই এক একজন বীর হয়েই দেশে ফিরছেন। মঙ্গলবার রাজধানী জাগরেবে বীরদের সংবর্ধনা দিবে ক্রোয়াটবাসী এবং সেদিনই হয়তো বরণ করে  নেবেন তাদের হারকিউলিসদের!

সর্বশেষ খবর