মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বপ্নের বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

স্বপ্নের বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ!

শেষ হয়ে গেল স্বপ্নের বিশ্বকাপ। ২০ বছর পর হারানো গৌরব উদ্ধার করেছে ফরাসিরা। দ্বিতীয় বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উৎসবে ভাসছে ফ্রান্স। রানার্স আপ হলেও প্রশংসায় ভাসছে ক্রোয়াটরাও। অভিষেকে তৃতীয়। ২০ বছর পর ফাইনালে উঠে নজর কেড়েছে ছোট দেশটি। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফেবারিটদের পেছনে ফেলে নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে রাশিয়া। বাংলাদেশ কখনো বিশ্বকাপ খেলেনি। ফুটবলের যে বেহাল দশা তাতে বাংলাদেশের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ক্রোয়েশিয়া যদি এত দ্রুত ফুটবলের উন্নয়ন ঘটাতে পারে বাংলাদেশ কেন পারবে না? অথচ বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। তা চূড়ান্ত পর্বে খেলা অনেক দেশেই হয় না। এ নিয়ে কথা বলেছেন দেশের কিংবদন্তি চার  ফুটবলার— আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, শেখ মো. আসলাম ও সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির। ফুটবলে এক সময় জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। মোহামেডান আবাহনী ম্যাচ মানেই দেশে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। সেই ফুটবলে এখন কি করুণ দশা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনাল খেলা যেখানে স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সেখানে বিশ্বকাপের স্বপ্ন্ন ভাবাই যায় না। বছর তিনেক আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ঘোষণা দিয়েছিলেন ভিশন টোয়েন্টি টু। অর্থাৎ ২০২২ সালে বিশ্বকাপ খেলার পরিকল্পনা নিয়েই তিনি এগুচ্ছেন। চার বছর পরই তো কাতারে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাহলে কি সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দেখা মিলবে?

আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু বলেন, ফুটবল বাংলার মানুষের রক্তে মিশে গেছে। দেখেন ঘরের মাঠে দর্শক প্রায় শূন্য থাকলেও বিশ্বকাপ ঘিরে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয় তা তো অনেক দেশেই হয় না। বিশ্বকাপ এলে কোনো বিদেশি ঢাকায় আসলে অবাক হয়ে যায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা দেখে। ইউরো লিগ ঘিরেও উত্তেজনার কমতি নেই। এত উন্মাদনা, এত উচ্ছ্বাস সেখানে কিনা দেশের ফুটবল মৃত্যুর মুখে। এত হতাশার মাঝেও আমি এখনো স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে। যদি আমাকে কেউ স্বপ্নবাজ মনে করে তবে ভুল করবেন। অনেকে বলছেন ক্রোয়েশিয়া পারলে আমরা কেন পারব না। আমি কিন্তু এই কথার সঙ্গে একমত নই। যুগোস্লাভাকিয়া ভেঙে ক্রোয়েশিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ফুটবলে যুগোস্লাভাকিয়ার শক্তির তো কমতি ছিল না। সেক্ষেত্রে ক্রোয়েশিয়া ভালো খেলতেই পারে।

চুন্নু বলেন, আমি তুলনা করব এশিয়ার দলগুলোর সঙ্গে। আমরা যখন খেলতাম তখন দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান বা জাপানের বিপক্ষে হারতাম ঠিকই। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতাম। এখন তারা যতটুকু এগিয়েছে তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে গেছি আমরা। ওরা বিশ্বকাপ খেলছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে। সততা ও দেশপ্রেম দুটোই রয়েছে। আমরা যখন খেলতাম তখনো বড় কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। কিন্তু ফুটবলকে একটা জায়গায় রেখে গিয়েছিলাম। সেই উন্মাদনা যদি কাজে লাগান যেত এতদিন বিশ্ব না হলেও এশিয়ান মানে যেতে পারতাম। এখন মালদ্বীপকে হারাবো তা ভাবতেই পারি না।

চুন্নু বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। ফুটবলের মান যারা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তাদের একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সাফেই যেখানে পাত্তা পাচ্ছি না সেখানে কি না দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ২০২২ সালে বিশ্বকাপ খেলার। জাতির সঙ্গে কী রসিকতা। গত ১০ বছরে ফুটবল একেবারে ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

যাক হতাশা বা ক্ষোভ থাকুক না কেন আমি হয়তো বেঁচে থাকব না তখন হয়তো একদিন পরের পতাকা বাদ দিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের পতাকা উড়াবে বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখা সহজ তা বাস্তবায়ন করাটা কঠিন। এই কঠিন কাজ করতে দরকার সৎ ব্যক্তিদের। তৃণমূল পর্যায় থেকে পরিকল্পনা নিতে হবে। জাপানের মতো দেশ পরিকল্পনা নিয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজয়ের। অর্থাৎ হুট করে অসম্ভবকে সম্ভব করা যাবে না। সবার একতা ও সৎ ব্যক্তিরা যদি এগিয়ে আসেন আমার বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যাবে। আর যদি লক্ষ্য ছাড়া স্বপ্নবাজ লোকদের হাতে ফুটবল জিম্মি থাকে তাহলে বিশ্বকাপ কেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপই বড় স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে।

সালাম মুর্শেদী ১০ বছর ধরে বাফুফের সিনিয়র সভাপতি। তিনিও অকপটে স্বীকার করলেন ফুটবলে অবনতির কথা। তিনি বলেন, প্রশ্ন আমারও আমরা আর কতদিন বিশ্বকাপে অন্য দেশকে নিয়ে উন্মাদনায় মাতবো। দেখেন আমরা ফুটবলে দায়িত্বে আছি বলে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয় আমাদেরই। স্বীকার করব আমাদের ভুল-ত্রুটি আছেই। ফুটবলকে সেভাবে জাগাতে পারেনি। এই হতাশা তো আর হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। আমরা যখন খেলতাম জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়াকে হারিয়েছি, থাইল্যান্ডকেও হারাতাম। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে লাল দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মোহামেডান এশিয়ান ক্লাব কাপ ফুটবলে ইরানের পিরুজিকে হারানো, উত্তর কোরিয়া, কাতার দলের সঙ্গে ড্র করেছিল। সালামের মতে, ওই সময়ে বাংলাদেশের মান এশিয়ার শক্তিশালী দলের সঙ্গে তুলনা করা হতো। এমন অবস্থার পরও কেন নজর দেওয়া হয়নি। টার্গেট লক্ষ্য করলে এতদিনে হয়তো বিশ্বকাপ খেলতাম না। এশিয়ার পর্যায়ে যাওয়াতো যেত। স্বর্ণালী সময়টা আমরা কাজে লাগাতে পারেনি। ফুটবল ধসের পথ সেই থেকে তো শুরু। যাক অতীত ঘাটতে চাই না। দায়িত্বে যখন আমরা তখন সব দোষ আমাদের মাথা পেতে নিতে হবে। সালাম দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, এখনো বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব। পথটা কঠিন, তবু আশাবাদী। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অর্থ। পথটা এত দীর্ঘ যে ওই সময়ে নিশ্চয় অন্যরা ফুটবলের দায়িত্বে থাকবেন। তবে এখন থেকেই লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে। এজন্য দরকার সবার সহযোগিতা। সমালোচনা করেন ঠিকই আজ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না ভুলটা ধরিয়ে দিতে। একতাই পারে ফুটবলকে জাগাতে। যদি পরিশ্রম ও উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় অবশ্যই বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে। শেখ মো. আসলাম বলেন, ফেডারেশনে আমিও নির্বাচিত সদস্য। তবু বলবো ফুটবলে যা ক্ষতি হওয়ার তা ১০ বছরেই হয়ে গেছে। খারাপ খেললে আমরা ফুটবলারদের তিরস্কৃত করি। কিন্তু ওরা কেন খারাপ খেলছে তা কখনো তলিয়ে দেখি না। এক নেতা এক ফেডারেশন এই নীতিতে ফুটবল চলছে। উন্নয়নে যে সবার সহযোগিতা দরকার তা আমরা ভাবছি না। বিশ্বকাপ এলেই প্রশ্নটা উঠে বাংলাদেশ কেন অন্য কোনো দেশকে নিয়ে উৎসবে মাতবে। ফুটবলার হিসেবে আমারও লজ্জা লাগে যখন দেখি পাশের বাসার ছাদে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের পতাকা দেখে। আসলাম বলেন, যা সর্বনাশ তাতো হয়েই গেছে। এখন আমাদের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। যদিও দীর্ঘ পথ তার পরও আমি বিশ্বাস করি দক্ষ ও সৎ লোকের নেতৃত্বে ফুটবল এগুতে পারলে ফুটবলে নতুনত্ব আসবে। একাডেমি, স্কুল ফুটবল, জেলায় নিয়মিত লিগ, শেরেবাংলা বা সোহরাওয়ার্দী কাপ নিয়মিত চালু রাখলে অনেক ফুটবলারের দেখা মিলবে। তাদের বাছাই করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে পারলে প্রথমে এশিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপে বিশ্ব ফুটবলে পা ফেলা সম্ভব। কাজ করবেন না বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখাবেন এমন অযৌক্তিক বক্তব্য মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সৈয়দ রুম্মন ওয়ালি বিন সাব্বির বলেন, বিশ্বকাপ সে তো স্বপ্নের পথ। এখন তো আমরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনাল খেলবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বকাপের স্বপ্ন আপনি কখন দেখবেন যখন আপনি এশিয়ার টপ টেনে জায়গা করে নিতে পারবেন। আমরা তো সেই সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিলাম। কিন্তু নজর না দেওয়াতে সব ভেস্তে গেছে। আর গত ১০ বছরে কর্মকর্তারা ফুটবলকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এত হতাশা তবু আমি বিশ্বাস করি বিশ্বকাপে খেলাটা আমাদের জন্য অসম্ভবের কিছু নয়। সম্ভব যে করবেন এর জন্য দরকার দেশপ্রেম ও সততা। প্রতিশ্রুতি দিয়ে হয়তো বাহ্বা পাওয়া যায়। কিন্তু ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হয় না। ধ্বংস থেকে বের হয়ে আসতে পারলে সব অসম্ভবই সম্ভবে রূপান্তরিত করা যাবে।

সর্বশেষ খবর