শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

এ এক নতুন বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ১ : ০ পাকিস্তান

আসিফ ইকবাল

এ এক নতুন বাংলাদেশ

শেষ মুহূর্তে তপু বর্মণের গোল। পাকিস্তানকে হারিয়ে সেমিফাইনাল অনেকটা নিশ্চিত করে ফেলল বাংলাদেশ —রোহেত রাজীব

দুপুর থেকেই ঢাকার সবগুলো রাস্তা এসে থেমেছে গুলিস্তানে। ক্রীড়াপ্রেমীদের সবার পথ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামমুখী। কাতারের পর ভুটানকে হারিয়ে ফুটবল জাগরণে হাঁটতে থাকা ফুটবলের সঙ্গী হতে হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা বাসে চড়ে উপস্থিত হয়েছেন স্টেডিয়ামে। কারও হাতে লাল-সবুজ পতাকা। কারও হাতে পোস্টার, কেউ কেউ এনেছেন আবার লাল-নীল-হলুদ রঙের ব্যানার। পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার- সবখানে লেখা ‘ফুটবল আমাদের প্রাণের খেলা’; ‘ফুটবল আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে’। ফুটবলপ্রেমীরা যে স্বপ্ন নিয়ে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন, তপু বর্মণ, মামুনুল, সুফিলরা তাদের মাথা নিচু করে বাড়ি পাঠাননি। বরং বাড়ি পাঠিয়েছেন উৎসবের হাজার রঙে রাঙিয়ে। তপু বর্মণের শেষ সময়ের দুর্দান্ত হেডে অসাধারণ জয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে নেচে-গেয়ে সবাই বাড়ি ফিরেছেন। জেমি ডে-এর ছোঁয়ায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সবুজ দেশটি এখন যেন নতুন বাংলাদেশ। জেমি, সুফিল, তপুরা এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সোনালি উত্থানের। ভুটান জয়ে শুরু। গতকাল সেটা শতভাগ পূর্ণতা পেল পাকিস্তান জয়ের পর। সিন্ধু নদের দেশ পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারিয়ে ‘এ’ গ্রুপে টানা দুই জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে সবার উপরে বাংলাদেশ। আগামীকাল নেপালের বিপক্ষে পয়েন্ট পেলেই গ্রুপের শীর্ষ  থেকে ২০০৯ সালের পর পুনরায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল খেলবে ২০০৩ সালের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ।

ম্যাচ শেষ। ফুটবলাররা ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছেন ড্রেসিং রুমে। কোচ জেমি ডে শিষ্যদের পিঠ চাপড়িয়ে, বুকে নিয়ে আলিঙ্গন করে কানে কানে যেন বলছেন, ‘তোমাদের হাতেই বাংলাদেশ ফুটবলের মশাল। তোমরা জ্বালিয়ে দাও!’ ফুটবলাররা যখন অবিশ্বাস্য জয়ে ক্লান্ত, তখন স্টেডিয়ামের চারপাশে সমর্থকের কোরাস ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’। অবিশ্বাস্য! এ কোরাস জায়গা এখন স্মৃতির ভাগারে। অথচ ৮০, ৯০ দশকে ফুটবলের এমন দৃশ্য ছিল নিত্যকার। হারিয়ে যাওয়া সোনালি সময় ফিরিয়ে আনতে মরিয়া সুফিলরা গতকাল ফিরিয়ে এনেছিলে সুখস্মৃতি।

পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ বরাবরই ফেবারিট। সব ধরনের ফুটবলে দুই দলের লড়াইয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ১৯ ম্যাচের লড়াইয়ে বাংলাদেশের জয় ৯টি। ড্র ও হারের সংখ্যা সমান ৫টি করে। গোল করেছে বাংলাদেশ ১৯টি। বিপরীতে গোল খেয়েছে ৮টি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও এগিয়ে বেঙ্গলরা। ৭ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৩টি এবং হার ও ড্র দুটি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১৩ সালে দুই দলের সর্বশেষ মুখোমুখিতে হেরেছিল বাংলাদেশ। ১-২ গোলে হারের প্রতিশোধ নিল এবার ১-০ গোলে জিতে। সব মিলিয়ে তিন জয়ের সবার বড়টি ৪-০ ব্যবধানে।

৩২ মাস আগে ঘরের মাঠে সর্বশেষ জিতেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। এরপর আর জয় পায়নি। উল্টো গোলশূন্য ড্র করে ভুটানের সঙ্গে। ২০১০ সালের অক্টোবরে থিম্পুতে হেরে যায় ভুটানের কাছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের গ্রাফ নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া বাংলাদেশ চলতি জুলাইয়ে ১৭ মাসের বন্ধ্যত্ম ঘুচিয়ে ২-২ গোলে ড্র করে লাওসের সঙ্গে। এরপর থেকে উপর উঠতে থাকে গ্রাফ। জার্কাতা এশিয়াডে অবিশ্বাস্য ফুটবল খেলে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলে। ১-১ গোলে ড্র করে থাইল্যান্ডের সঙ্গে এবং ১-০ গোলে হারায় কাতারকে। সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই ঘরের মাঠে আলোকিত ফুটবল খেলছে বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ম্যাচে তপু ও সুফিলের গোলে ২-০ গোলে হারায় ভুটানকে। স্বস্তির জয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার পর গতকাল গতিশীল ফুটবল খেলে পাকিস্তানের রক্ষণব্যূহকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন সুফিলরা। প্রথমার্ধে বেশ কয়েকটি সুযোগ পাওয়ার পরও ফিনিশিংয়ের অভাবে গোল করতে পারেনি বাংলাদেশ। তখন মনে হচ্ছিল ভাগ্য সহায় নেই স্বাগতিকদের। দ্বিতীয়ার্ধে উজ্জ্বীবিত ফুটবল খেলতে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনেন একাদশে। অবশ্য সাবেক অধিনায়ক মামুনুল শুরু থেকেই ছিলেন একাদশে। দ্বিতীয়ার্ধে একের পর এক আক্রমণ করে যখন ক্লান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছিল দলকে, তখনই  কোটি টাকা মূল্যমান গোলটি করলে গ্যালারিতে উপস্থিত ২৫ হাজার দর্শককে উন্মাতাল আনন্দে মাতান তপু বর্মণ। ৮৬ মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে বিশ্বনাথ ঘোষের লম্বা থ্রো ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন পাকিস্তানের রক্ষণভাগ। তখনই জটলায় দাঁড়িয়ে হেডে গোল করে দলকে জয়োৎসবে ভাসান তপু (১-০)। ওই গোলের পর আরও একবার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এবার বলের সামনে কোনো ফুটবলার না থাকায় গোল হয়নি। এরপর রেফারি ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে গোটা দল প্রজাপতির ডানা লাগিয়ে উড়তে থাকে গোটা মাঠে। এ যেন বিশ্ব জয়ের উৎসব!

তপুর অবিশ্বাস্য গোলটি ফের প্রমাণ করলো বাংলাদেশ এখন নতুন এক ফুটবল শক্তি। যারা এখন ম্যাচের শেষ বেলাতেই গোল করতে পারে। কাতার, উত্তর কোরিয়ার পর সর্বশেষ প্রমাণ পাকিস্তান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর