রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
টাইগারদের উল্লাস

তামিমের ত্যাগ মুশফিকের ক্যারিশমা

মেজবাহ্-উল-হক

তামিমের ত্যাগ মুশফিকের ক্যারিশমা

তখনো ১৯ বল খেলার বাকি ছিল। কিন্তু পতন ঘটে যায় নবম উইকেটের। দলের রান ২২৯ মাত্র! ১২২ রানে অপরাজিত মুশফিকুর রহিম হতাশায় ড্রেসিংরুমের দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু সামনের দৃশ্যটা দেখে যেন মিস্টার ডিপেন্ডেবলের দেহ-মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এ কি, তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে এগিয়ে আসছেন!

প্রথম দেখায় হয়তো ঘটনাটি বিশ্বাসই হয়নি মুশফিকের। কেননা একটু আগেও যে তামিম ভাঙা বাঁ হাতটা গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে নিয়ে ড্রেসিংরুমে বসে ছিলেন তিনি মাঠে নামছেন ব্যাট হাতে নিয়ে! ঘটনাটি অবিশ্বাস্য লাগছিল দর্শকদেরও। হয়তো গোটা ক্রিকেটবিশ্বেরই।

গতকাল ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই হাতে আঘাত পেয়ে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে মাঠের বাইরে যান তামিম। ব্যথা এতটাই তীব্র ছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে ড্যাসিং ওপেনারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই তামিম দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে নিজের ইনজুরি তুচ্ছজ্ঞান করে বাইশগজে ফিরলেন। প্রিয় মুশফিককে সঙ্গ দিতে মাঠে নামলেন। প্রথমেই পড়লেন লঙ্কান বোলার সুরঙ্গা লাকমলের গতির সামনে। ভাঙা হাতে লাগলে ইনজুরি ভয়ঙ্কর হতে পারে, তাই বাঁ হাতটা শরীরের আড়ালে লুকিয়ে রাখলেন। ডান হাত দিয়ে দারুণভাবে ঠেকিয়ে দিলেন বল। দৃশ্যটি যেন ক্রিকেটের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।

এদিকে ভাঙা হাত নিয়ে সতীর্থ তামিমের মাঠে নামার ঘটনাটি যেন মুশফিককে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। দুবাইয়ের প্রচণ্ড গরমে এবং দীর্ঘ সময় ব্যাটিংয়ের কারণে সেঞ্চুরির পর ক্লান্ত হয়ে পড়া মুশি যেন নতুন করে শক্তি পেলেন। তাই বাকি বলগুলো একাই খেললেন। তামিমকে নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে রেখেই দলীয় খাতায় যোগ করেন আরও ৩২ রান। দলীয় স্কোর হয়ে যায় ২৬১। শেষ ওভারে মুশফিক আউট হওয়ার আগে করেন ১৪৪ রান। খেলেছেন ১৫০ বল। ১১টি বাউন্ডারির সঙ্গে ৪টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। নিঃসন্দেহে মিস্টার ডিপেন্ডেবলের ক্যারিয়ারে সেরা সেঞ্চুরি। যদিও মুশফিকের করা আগের ৫টি সেঞ্চুরিও দারুণ। কিন্তু কালকের এই সেঞ্চুরির কোনো তুলনা হয় না। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মাঠে নেমেছিলেন। এক প্রান্ত আগলে রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন।

মুশফিককে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন মোহাম্মদ মিথুন। প্রথম ওভারে মালিঙ্গার আঘাতে লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান ফিরে যাওয়ার পরের ওভারে ইনজুরিতে পড়েছিলেন তামিম। এরপর মিথুনকে নিয়ে ১৩১ রানের জুটি গড়েন মুশফিক। তৃতীয় উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের রেকর্ড পার্টনারশিপ। এর আগে তৃতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল ৯৯। সেখানেও তামিমের সঙ্গে ছিলেন মুশফিক, ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। কাল মুশফিক-মিথুনের জুটি যেন কোমা থেকে টেনে তুলেছে বাংলাদেশকে।

মুশফিকের ইতিহাস গড়ার দিনে ওয়ানডের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি আদায় করে নিয়েছেন মিথুন। ৬৮ বলে খেলেছেন ৬৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। তার ইনিংসে ছিল ৫টি বাউন্ডারির সঙ্গে ২টি বিশাল ছক্কা। যদিও ডাবল ফিগারে পৌঁছার আগেই দুবার নতুন জীবন পান তিনি। প্রথমবার তো স্বয়ং লঙ্কান দলপতি অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস মিথুনের ক্যাচটি ফেলে দিয়েছেন। দ্বিতীয়বার অবশ্য নো-বলে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি। কাল নতুন জীবন পান মুশফিকুর রহিমও। ৩১ বলে তার স্কোর যখন ১০ তখন স্কোয়ার লেগে ক্যাচ ফেলে দেন লঙ্কান ফিল্ডার দিলরুয়ান পেরেরা। তবে ক্যাচ মিসও তো খেলারই অংশ।

কাল বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন লাসিথ মালিঙ্গা। ১৬ মাস পর খেলতে নেমে মাত্র ২৩ রানে ৪ উইকেট নেন ৩৬-এ পা দেওয়া এই গতি তারকা। প্রথম ওভারেই ২ উইকেট নেন। তবে মালিঙ্গা ঝড়ের পর তামিমের ইনজুরিতেও আত্মবিশ্বাস হারায়নি বাংলাদেশ। দুই ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ মিথুন প্রথমে বাইশগজে গিয়ে উইকেট মেরামত করায় মনোনিবেশ করেন। রান করার চেয়ে উইকেটে সেট হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দেন দুই তারকা। মুশফিক-মিথুন এতটাই সাবধানতার সঙ্গে খেলেছেন যে, প্রথম বাউন্ডারিটি এসেছিল ৪৮তম বলে। তবে ১১তম ওভার থেকেই বদলে যায় টাইগারদের ব্যাটিং স্টাইল। প্রথম ১০ ওভারে যেখানে এসেছিল মাত্র ২৪ রান, সেখানে পরের ১০ ওভারে আসে ৭৮ রান। তবে মুশফিক ও মিথুনের জুটি ভাঙার পরই বিপদে পড়েছিলেন টাইগাররা। বাংলাদেশ যেন কাল বার বার ঝড়ের কবলে পড়তে থাকে। প্রথম ঝড়ে ৩ রানের মধ্যে তিন ব্যাটসম্যান সাজঘরে। দ্বিতীয় ঝড়ে ৮ রানের মধ্যে আবারও তিন উইকেট নেই— মিথুনের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে ফেরেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন। অর্থাৎ ১৩৪/২ থেকে হঠাৎ স্কোর হয়ে যায় ১৪২/৫। মিথুনের বিদায়ের পরও মাহমুদুল্লাহ ও মোসাদ্দেক বিদায় নিয়েছেন ব্যক্তিগত খাতা ১ রান করে যোগ করে। এরপর মিরাজ, মাশরাফি, রুবেলও টিকতে পারেননি বাইশগজে। তবে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক প্রান্ত ঠিকই আগলে রেখে লড়াই করে গেছেন মুশফিক। শেষ দিকে তামিমের সঙ্গে ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত উপহার দিয়ে বাংলাদেশকে এনে দেন লড়াকু স্কোর।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ : ২৬১/১০ (৪৯.৩ ওভার), শ্রীলঙ্কা : ১২৪/১০ (৩৫.২ ওভার)

সর্বশেষ খবর