বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্রিকেটাররা কি টেস্ট ভুলে যাচ্ছেন?

মেজবাহ্-উল-হক

ক্রিকেটাররা কি টেস্ট ভুলে যাচ্ছেন?

রেকর্ড গড়ে হলো না বিজয়। দ্বিতীয় ইনিংসেও হতাশাজনক ব্যাটিংয়ে সিলেট টেস্টে হেরে সিরিজে পিছিয়ে পড়ল বাংলাদেশ। এগিয়ে থাকল জিম্বাবুয়ে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

অধিনায়কের ক্যারিশম্যাটিক সিদ্ধান্ত, কোচের কার্যকরী ভূমিকা কিংবা টিম ম্যানেজমেন্টের সুপরিকল্পনা—এসবের কিছু কি চোখে পড়েছে সিলেট টেস্টে! সাকিব-তামিম না থাকাটা বড় ধাক্কা বটে —কিন্তু জিম্বাবুয়ের মতো ‘পুুঁচকে’ দলের বিরুদ্ধে ১৫১ রানের বিশাল ব্যবধানে হারের পর এমন অজুুহাত কি ধোপে টিকবে?

আসলে কে খেলেছেন, আর কে খেলেননি সেটা বড় বিষয় নয়— টেস্টে বাংলাদেশ দল তো ধারাবাহিকভাবেই ব্যর্থতার চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ের জন্য। শেষ আট ইনিংসে বাংলাদেশ দলের স্কোর ‘দুইশ’ পার হয়নি। ব্যাটিংয়ে এই লজ্জার ‘ধারাবাহিকতা’র পরিণতি এমন বাজে হার! জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্টের দল গঠন এবং একাদশ নির্বাচন নিয়েও ছিল অনেক প্রশ্ন? প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দলই যেখানে দল নির্বাচনের জন্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পারফরম্যান্সকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সেখানে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দেওয়ার পরও তুষার ইমরানকে সুযোগ দেওয়া হয়নি! কিন্তু কেন? সাম্প্রতিক ওয়ানডেতে মিডল অর্ডারে দারুণ ব্যাটিং করছেন মোহাম্মদ মিথুন। সিলেটে তার অভিষেক প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তাকে নেওয়া হয়নি।

একাদশে কেন মাত্র একজন পেসার? টিম ম্যানেজমেন্ট কি তবে আগেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে! যে দলটিকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে টাইগাররা পাত্তাই দিল না, যে দলটি গত দেড় যুগে দেশের বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে পারেনি, সেই দলটিকে কেন এত ভয় পেয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট? বাংলাদেশ তো এখন আর ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে এক পেসার নিয়ে খেলে না তাহলে কেন টেস্টে এমন ‘দুর্বল’ সিদ্ধান্ত?

তবে অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের মতে এই টেস্টে বাংলাদেশকে ডুবিয়েছে কেবলমাত্র ব্যাটসম্যানরাই, ‘শুধু একটা জিনিসই বলতে পারি, টেস্ট ক্রিকেট খেলতে গেলে যতটুকু ডিসিপ্লিনড থাকা দরকার, আমার মনে হয় ততটুকু ছিলাম না আমরা। উইকেট বেশ ভালোই ছিল। ডিসিপ্লিনের বিষয়টা আমাদেরকে আরেকটু ভালো করে দেখতে হবে। আর নিজেদের ওপর বিশ্বাস আরেকটু বাড়াতে হবে। বেশ কয়েকটি টেস্টে আমরা বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এই জিনিসগুলো নিয়ে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে এবং একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’ একজন ক্রিকেটারের জন্য জরুরি হচ্ছে ‘সেল্ফ কনসাসনেস’, কিন্তু এই টেস্টে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যায়নি। যে ইমরুল এই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ৩৪৯ রান করলেন, সেই কিনা একই দলের বোলারদের বিরুদ্ধে ‘বাক্সবন্দী’ হয়ে গেলেন। আরেক ওপেনার লিটন কুমার দাসকেও ভীষণ নার্ভাস মনে হচ্ছিল বাইশগজে। উইকেটে সেট হওয়ার পরও ওপেনাররা ভালো করতে পারেননি। ‘স্পেশালিস্ট টেস্ট ব্যাটসম্যান’ মুমিনুল হক প্রথম ইনিংসে সুবিধা করতে পারেননি, কিন্তু কাল প্রথম বলেই দুর্দান্ত এক বাউন্ডারি দিয়ে রানের খাতা খোলে অন্য বার্তা দিয়েছিলেন। একটু পর দেখা যায়, ‘যে লাউ সেই কদু’— ডাবল ফিগারে পৌঁছার আগেই সাজঘরে ফেরেন। দুই ওপেনার মিলে ৫৬ রানের জুটি গড়ে দেওয়ার পর ওয়ান ডাউনে নামা মুমিনুলের দায়িত্ব ছিল ইনিংসটাকে লম্বা করা। কিন্তু তিনি আবারও ব্যর্থ।

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যেন নেতৃত্বের চাপে ব্যাটিংই ভুলে গেছেন! প্রথম ইনিংসে রানের খাতা খুলতে পারেননি, আর দ্বিতীয় ইনিংসে দলের মহাবিপদের সময় আউট হয়ে গেছেন ভুল শট খেলে। শট বলে অযথাই সুইপ খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন টাইগার দলপতি।

নাজমুল হোসেন শান্তকে দেখে মনে হচ্ছিল, উইকেটে বেশ সেট হয়ে গেছেন। কিন্তু ৩২ বলে ১৩ রান করার পর যেন তার মনে হলো অনেক হয়েছে এবার ফেরা যাক— তা না হলে কেউ মধ্যাহ্ন বিরতির একটু আগে এমন ‘হাস্যকর’ শট খেলে ক্যাচ তুলে দেয়! প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। উইকেটে দারুণভাবে সেট হওয়ার পরও ইনিংসটা বড় করতে পারলেন না। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৩১, আর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩। অযথাই বিলাসী শট খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

তবে দুই ইনিংসেই সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন একমাত্র ব্যাটসম্যান অভিষিক্ত আরিফুল হক। লড়াই জমিয়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দুই ইনিংসেই। কিন্তু সঙ্গীর অভাবে আর হয়ে ওঠেনি। প্রথম ইনিংসে ৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে করেছেন ৩৮ রান। অবশ্য এজন্য আরিফুলকে দোষ দেওয়া যায় না— কেন না দুই ইনিংসেই তাকে দেখতে হয়ে অপরপ্রান্তের উইকেট পতনের মর্মান্তিক দৃশ্য। গতকাল তাই বাধ্য হয়েই চড়াও হতে হয়েছিল। চার বাউন্ডারির সঙ্গে দুটি বিশাল ছক্কাও হাঁকিয়েছেন। অবশ্য আরিফুল যখন ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছেন তার আগেই ম্যাচ জিম্বাবুয়ের গ্রিপে চলে গিয়েছিল, বাকি ছিল কেবল জয়ের আনুষ্ঠানিকতা!

বাংলাদেশ দল দিন দিন ওয়ানডেতে যতটা শক্তিশালী হচ্ছে, টেস্টে যেন ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজ। তারপর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হোয়াইওয়াশ। সিলেটে জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিরুদ্ধে লজ্জাজনক হারের পর যেন একটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে— বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কি টেস্ট খেলা ভুলে যাচ্ছেন?

সংক্ষিপ্ত স্কোর

জিম্বাবুয়ে :           ২৮২/১০ ও ১৮১/১০

বাংলাদেশ             :           ১৪৩/১০ ও ১৬৯/১০

সর্বশেষ খবর