১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই ফুটবলকে পেছনে ফেলে ক্রিকেট জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছে। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে অভিষেকের পর বাংলাদেশ নিয়মিত ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা আসরে অংশ নিচ্ছে। টি-২০ বিশ্বকাপে শুরু থেকেই খেলছে। বড় কোনো শিরোপা না জিতলেও পারফরম্যান্সের কারণে বিশ্বজুড়েই ক্রিকেটে পরিচিতি লাভ করেছে। সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম ও মাহমুদুল্লাহরা তো বিশ্ব ক্রিকেটেও তারকা খ্যাতি পেয়েছেন। অথচ একসময় এ খেলার অবস্থা এতটাই নড়বড়ে ছিল যে, ঘরোয়া আসর চালাতে ফান্ড সংকটে পড়ত। তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট বোর্ডের অফিসের বিদ্যুৎ একাধিকবার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কারণ অর্থ সংকটে বিল নিয়মিত শোধ করতে পারত না।
সেই ক্রিকেট কোথায় আজ উঠে গেছে! ফুটবলের আলো টিম টিম করে জ্বলছে। যে খেলার ঢাকা লিগ ঘিরেই দেশ কাঁপত, বেশ কবার ফুটবলের গেটমানি দিয়ে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডকে আর্থিক সহায়তা করেছিল বাফুফে। এখন মিরপুরে বিসিবি কার্যালয় হলেও নানা তথ্য নিতে সাংবাদিকরা গিজগিজ করেন। অথচ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তেমন দেখা মিলত না। দেখা যেত তবে তা ক্রিকেট লিগের স্কোর কার্ড সংগ্রহ করতে। প্রশ্ন উঠতে পারে-হঠাৎ কেন এ ইতিহাস টানা হচ্ছে?
বলার কারণটা তৈরি হয়েছে মঙ্গলবার নেপালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ শিরোপা জেতায়। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন গঠন হয়। ’৭৩ সালেই আন্তর্জাতিক আসরে অভিষেক হয় বাংলাদেশ জাতীয় দলের। সেবার জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সাল থেকে ধরা হলে ৫১ বছরে বাংলাদেশ পুরুষ দলের শিরোপা জেতার সংখ্যা ৯। তা-ও আবার জাতীয় ও বয়সভিত্তিক মিলিয়ে।
জাতীয় দল মারদেকা কাপ, থাইল্যান্ডের কিংস কাপ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্স কাপ, ভুটান কিংস কাপ, ভারতের নেহরু কাপ, মিয়ানমারের চ্যালেঞ্জ কাপ, এসএ গেমস, সাফ চ্যাম্পিয়নসহ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অংশ নেয়। এসএ গেমসের বাংলাদেশের দ্বিতীয় সোনা জিতেছে আবার অনূর্ধ্ব-২৩ দল। কেননা ২০০৪ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসে ফুটবল ইভেন্ট ২৩ বছর বয়সির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। তিন শিরোপা এসেছে সাফ বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট থেকে। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬ ও শেষটি ছিল অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। জাতীয় দলের শিরোপার সংখ্যা মূলত পাঁচটি। ১৯৮৯ সালে ঢাকা অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ লাল দল। নাম লাল হলেও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে দলটি গঠন হয়। এটিই ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম ট্রফি জয়। এরপর মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি চ্যালেঞ্জ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এটি আবার দেশের বাইরে প্রথম শিরোপা।
১৯৮৪ সালে সাফ গেমসের যাত্রা। দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক খ্যাত এ গেমস শুরু হওয়ার পর ক্রীড়াপ্রেমীদের ধারণা ছিল সোনা জয়ের লড়াই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। ১৯৮৪ সালে তো সোনা জেতাটা সময়ের ব্যাপার মনে হয়েছিল। ভারত সেবার ফুটবল ইভেন্টে অংশ নেয়নি। অথচ ফাইনালে নেপালের কাছে হেরে রুপাতেই সন্তুষ্ট থাকেন আসলামরা। গ্রুপের লড়াইয়ে এ নেপালকে ৫-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। যেখানে সোনা জেতাটা মামুলি মনে হয়েছিল সেই সাফেই চ্যাম্পিয়ন হতে অপেক্ষা করতে হয় ১৫ বছর। ১৯৯৯ সালে জুয়েল রানার নেতৃত্বে সাফ গেমসে প্রথম সোনা জেতে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়টি গোলরক্ষক আমিনুল হকের নেতৃত্বে ২০১০ সালে ঢাকায়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র একবার। ২০০৩ সালে রজনীকান্ত বর্মণের নেতৃত্বে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও এসএ গেমসে ব্যর্থতার কারণেই মূলত দেশের ফুটবলে নাজুক অবস্থা। ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক বাছাইয়ে নিয়মিত অংশ নিলেও কখনো বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারেনি। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশককে দেশের ফুটবলে স্বর্ণযুগ বলা হলেও ওই সময়ও বাংলাদেশ ছিল ব্যর্থতায় বন্দি। বিশ্বকাপ বাছাই ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে গোলের বন্যায় ভেসেছে। পরে অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে যে, মালদ্বীপ ও নেপালের বিপক্ষে জয় পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভুটানের কাছে হারতে হয়। সান্টু, সালাউদ্দিন, নান্নু, মঞ্জু, চুন্নু, কায়সার হামিদ, আসলাম, মুন্না, সাব্বিররা যত বড় তারকা হোন না কেন এশিয়ান পর্যায়েও খ্যাতি অর্জন করেননি। ফুটবলে হতাশার মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়েছেন অনূর্ধ্ব-২০ দলের ফুটবলাররা। অনেক দিন পর যে কোনো আসরে নেপালকে বড় ব্যবধানে হারাল বাংলাদেশ। এই ছেলেরা সামনে কত দূর যাবে সেটাই অপেক্ষা।