যাতায়াত ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে দ্রুতগতির ট্রেনগুলো আজকের বিশ্বের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফসল। অনেকে জানতে চান, দ্রুতগতির ট্রেন কাকে বলে? উত্তর হলো- সাধারণত যেসব ট্রেন ঘণ্টায় কমপক্ষে ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলে সেগুলোকে দ্রুতগতির ট্রেন বলা হয়।
সাধারণত বিমানের বিকল্প হিসেবে বুলেট ট্রেনের উদ্ভব। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সময় নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে বুলেট ট্রেনের উদ্ভাবন হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণত উচ্চগতির রেলপথ; দুটি ব্যবস্থা- গতি এবং দক্ষতা উভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হয়। ১৯৬৪ সালে জাপানে প্রথম দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা চালু হয়, যা বুলেট ট্রেন নামে পরিচিত। তার পর থেকে অনেক দেশ দ্রুতগতির ট্রেন তৈরি করেছে। জাপানের শিনকানসেন বুলেট ট্রেন থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ টিজিভি পর্যন্ত, দ্রুতগতির ট্রেনের অসংখ্য ইতিহাস রয়েছে, যা বেশ কয়েক দশক ধরেই বিস্তৃত।
১. এলজিরো শিনকানসেন, জাপান
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৬০৩ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৫০০ কিলোমিটার
জাপানের এলজিরো সিরিজের দ্রুতগতির ম্যাগলেভ ট্রেনটি বর্তমানে উন্নয়ন ও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। সেন্ট্রাল জাপান রেলওয়ে কোম্পানি ও রেলওয়ে টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরি ট্রেনে চৌম্বকীয় লেভিটেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
২. টিজিভি পিওএস, ফ্রান্স
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৫৭৫ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩২০ কিলোমিটার
ফ্রান্সের টিজিভি পিওএস (ট্রেন আ গ্রান্দে ভিতেসে পেন্দুলেয়ার) ট্রেনটিতে যত দ্রুত গতিতে মোড় নেয়, তখনো ভিতরে যাত্রীরা আরামে বসে থাকতে পারেন। এর কারণ, ট্রেনটি মোড় ঘোরানোর সময় পেন্ডুলামের মতো কাত হয়ে যায়। এ জন্যই এই ফরাসি ট্রেনের নামে পেন্ডুলামের উল্লেখ রয়েছে।
৩. টিজিভি আটলান্টিক, ফ্রান্স
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৫১৫ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩০০ কিলোমিটার
ফ্রান্সের তৈরি ট্রেন এ গ্র্যান্ডে ভিটেসে বা টিজিভি সিরিজের বুলেট ট্রেনটি ইউরোপের প্রথম দ্রুতগতির ট্রেন। ফ্রান্সের জাতীয় রেল কোম্পানি চালিত টিজিভি আটলান্টিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৯০ সালে। এটি তখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন হিসেবে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। এমনকি ইউরোপে দ্রুতগতির রেলের অগ্রদূত ট্রেনটি সূচনাকাল থেকে বারবার রেকর্ড ভেঙেছে।
০৪. সাংহাই ম্যাগলেভ, চীন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৫০১ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৪৬০ কিলোমিটার
অফিশিয়াল নাম সাংহাই ম্যাগলেভ। যদিও অনেকের কাছে এটি সাংহাই ট্রান্সর্যাপিড নামে পরিচিত। তালিকায় বুলেট ট্রেনটির অবস্থান শীর্ষে। চীনের বুলেট ট্রেনটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। এই ট্রেনের গড় গতির পরিমাণ প্রতি ঘণ্টায় ২৫১ কিলোমিটার। বিস্ময়কর হলেও বুলেট ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৫০১ কিলোমিটার।
০৫. সিআর হারমনি, চীন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৩৫০ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩৫০ কিলোমিটার
চায়না রেলওয়ে হেক্সি (সিআর), যা হারমনি নামেও বেশি পরিচিত। সিআর এইচ সিরিজের ইএসইউ হাই-স্পিড বুলেট ট্রেনটি ফাক্সিং ট্রেনের মতো একই গতিতে কাজ করে। সাধারণত ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে যাতায়াত করে সিআর হারমনি। এর সর্বোচ্চ গতি একই। দ্রুত গতির কারণে অত্যাধুনিক ট্রেনটি তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
০৬. সিআর ফাক্সিং, চীন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৪২০ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩৫০ কিলোমিটার
চায়না রেলওয়েরর আরেকটি বুলেট ট্রেন হলো- সিআর ফাক্সিং। সিআর সিরিজের বুলেট ট্রেনটি অনেকের কাছে ইএমইউ নামেও পরিচিত। চায়না রেলওয়ে করপোরেশনের ট্রেনটি প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এর সর্বোচ্চ গতি ওঠে ঘণ্টায় ৪২০ কিলোমিটার। সাধারণত ফাক্সিং মডেলের ট্রেনগুলো হলো- চীনের প্রথম সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন।
০৭. সিআরএইচ ৩৮০বি, চীন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৪৮৭ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩৮০ কিলোমিটার
স্থানীয়দের কাছে ট্রেনটি বিএল হেক্সি নামেও পরিচিত। ২০১১ থেকে চায়না রেলওয়ে করপোরেশন চালিত চীনের আরেকটি দ্রুত গতির ট্রেন সিআরএইচ৩৮০বি/বিএল হেক্সি। ট্রেনটির অ্যারোডাইনামিক আকৃতি এবং বর্ধিত ট্র্যাকশন শক্তি এর কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়।
০৮. সিআরএইচ ৩৮০এ হেক্সি, চীন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৪৮৬ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩৫০ কিলোমিটার
দ্রুত গতির ট্রেনের জগতে চীনের প্রভাব লক্ষণীয়। আধুনিক ট্রেনের সূচনাকাল থেকে দেশটির একের পর এক চমক দেখিয়ে আসছে। সিআরএইচ৩৮০বি/বিএল হেক্সির পরই রয়েছে এর আগের বছর থেকে চালু হওয়া ট্রেন সিআরএইচ৩৮০এ হেক্সি। পরবর্তীতে ট্রেনটিকে আবারও বিদেশি ডিজাইনের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো হয়।
৯. এভিই ক্লাস ১০৩, স্পেন
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৪৬০ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩১০ কিলোমিটার
স্পেনের রেনফে-অপারেডোরা ২০০৬ সাল থেকে এভিই ক্লাস ১০৩ ট্রেনটি পরিচালনা করে আসছে। এভিইর পূর্ণরূপ ‘আল্টা ভেলোসিদাদ এস্পাওলা’, যার মানে ‘স্প্যানিশ দ্রুতগতি’ এবং এর সংক্ষিপ্ত রূপ এভইর অর্থ ‘পাখি’। এভিই রেল সিস্টেম ইউরোপের দীর্ঘতম দ্রুতগতির রেল নেটওয়ার্ক। এটি ৩ হাজার ৯৬৬ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে, যা চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম বুলেট ট্রেন।
১০. কোরাইল কেটিএক্স-সানচেওন
দক্ষিণ কোরিয়া
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৩০০ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩০০ কিলোমিটার
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় রেলওয়ে অপারেটর, কোরাইল, দ্রুত গতির রেল পরিষেবা দিয়ে থাকে। কোরিয়া ট্রেন এক্সপ্রেস, সাধারণভাবে কেটিএক্স নামে পরিচিত, ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে। প্রায় ৭১টি ট্রেনসেট (বগি), যা নিয়ে ৩১৬ সেকেন্ডে ০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার ঘণ্টায় যাত্রা করতে পারে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্চগতির রেল নেটওয়ার্কে প্রতিটিতে ৩৬৩ জন যাত্রী বহন করে।
১১. ওএনসিএফ আল বোরাক, মরক্কো
♦ রেকর্ড প্রতি ঘণ্টায় : ৪৬০ কিলোমিটার
♦ সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় : ৩১০ কিলোমিটার
আফ্রিকার প্রথম হাইস্পিড ট্রেন, মরক্কোর আল বোরাক। মরক্কোর জাতীয় অপারেটর অফিস ন্যাশনাল ডেস চেমিন্স ডি ফের ডু মারক (ওএনসিএফ) এই পরিষেবা পরিচালনা করে থাকে। আল বোরাক বুলেট ট্রেনগুলো ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৫৭ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। তবে সাধারণত এর গড় গতির পরিমাণ ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার।
তথ্যসূত্র : রেলওয়ে টেকনোলজি