মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের কমতি নেই। মহাবিশ্ব বরাবরের মতোই মানুষকে নানাভাবে চমকে দিচ্ছে। প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত, মানুষ মহাকাশের এমন আবিষ্কার করেছে যা সত্যিই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু আবিষ্কার রয়েছে, যা মানবসভ্যতাকে দেখিয়েছে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নতুন দিগন্ত। অবিশ্বাস্য এসব আবিষ্কার সর্বকালের জন্যই সেরা আবিষ্কার হয়ে আছে। রইল বিস্তারিত...
সম্প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব!
১৯২৯ সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন। তা হলো- ‘সম্প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব’। এ সম্প্রসারণ হচ্ছে মহাশূন্যের মধ্যেই। অর্থাৎ আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে অন্য গ্যালাক্সিগুলোর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ওগুলো আমাদের গ্যালাক্সি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে ছায়াপথের দূরত্ব তাদের চলাচলের গতি বর্ণনা করা হয়। এর আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসে। বলা হয়, মহাশূন্যের সম্প্রসারণ ঘটছে ত্বরিত গতিতে।
এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার
সৌরজগতের বাইরের প্রথম গ্রহগুলোর আবিষ্কার হয়- ১৯৯২ সালে। এক্সোপ্ল্যানেট হলো- সৌরজগতের বাইরে অবস্থিত গ্রহ। প্রথমদিকে মানুষ শুধু সূর্যের আশপাশের গ্রহের ব্যাপারেই জানত। পরবর্তীতে আরও অনেক গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে। তবে ১৯১৭ সালে প্রথম এমন ধারণার উদ্ভব হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ ধারণ প্রমাণ করে, মহাবিশ্বে গ্রহ ব্যবস্থা বিদ্যমান। এক্সোপ্ল্যানেটের আবিষ্কারে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। সৌরমন্ডলের বাইরে আজ অবধি ৫০০০-এর বেশি গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে।
মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে ব্ল্যাক হোল!
‘ব্ল্যাক হোল’ আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে আকর্ষণীয় মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। আমরা যে গ্যালাক্সিতে অবস্থান করছি, তার নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এর কেন্দ্রেও আছে ‘ব্ল্যাক হোল’ ১৯৭৪ সালের ২০ মার্চ, হঠাৎ পৃথিবীতে একটি শক্তিশালী রেডিও সংকেত আসে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, এই সংকেত মিল্কিওয়ের অভ্যন্তরে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা এর নাম দেন, ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল’। সূর্যের চেয়ে এর ভর ৪০ লাখ গুণ বেশি। এর অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে।
কসমিক মাইক্রোওয়েভ
১৯৬৫ সালে, আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন তাদের রেডিও টেলিস্কোপে একটি অস্বাভাবিক সংকেত আবিষ্কার করেন। এটি ছিল ‘বিগ ব্যাগ’-এর অবশিষ্ট বিকিরণ যা আফটারগ্লো হিসেবে বিবেচিত। সহজ করে বললে, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সৃষ্টির সময় মহাবিশ্ব খুব তপ্ত এবং জমাট অবস্থায় ছিল। এখনো এই বিকিরণের রেশ থেকে গিয়েছে মহাবিশ্বের সর্বত্র। একে ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের সমর্থনকারী একটি শক্তিশালী প্রমাণ। এটি অতি প্রাচীন মহাবিশ্বের ছবি। যা বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্ব কীভাবে বিকশিত হয়েছিল তা বোঝার সুযোগ এনে দিয়েছে।
মঙ্গল গ্রহে পানি!
২০১৫ সালের ২০ জুলাই, নাসার বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহে একটি চমৎকার আবিষ্কারের সন্ধান পান। তা হলো- পানি। নাসা জানায়, এক সময় মঙ্গল গ্রহে পানি প্রবাহিত হতো। ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, ৩০০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের উপরিভাগে হ্রদ, নদী ও মহাসাগর ছিল। যা মূলত ‘প্রাণের অস্তিত্বের প্রতিশ্রুতিশীল একটি আবিষ্কার’। গবেষণার এ ফলাফল যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে প্রাণের যেসব উৎস সম্পর্কে আমরা জানি, সেগুলো মঙ্গলেও রয়েছে। এর থেকে ধারণা করা হয়, এক সময় এই গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। কয়েক দশক ধরে, গবেষকরা মঙ্গলে পানির সন্ধান করছিলেন। আর মঙ্গল গ্রহে পানি প্রবাহের প্রমাণ পাওয়ায় বিজ্ঞানীদের মাঝে ‘প্রাণের নতুন আশা’ দেখা দিয়েছে। এই আবিষ্কারে সঙ্গে মহাজাগতিক ‘ডার্ক এনার্জি’ এবং ‘ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণাগুলো ত্বরান্বিত হয়।’
ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি
১৯৭০ সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে নক্ষত্রের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে দেখলেন, এর অভ্যন্তরে দৃশ্যমান পদার্থের চেয়ে অনেক বেশি অদৃশ্য পদার্থ রয়েছে। অর্থাৎ দৃশ্যমান বস্তুর বাইরেও অনেক বেশি অদৃশ্য বস্তু রয়েছে। এ ধরনের রহস্যময় শক্তি ডার্ক ম্যাটার নামে পরিচিত। পরে আবিষ্কৃত হয় ডার্ক অ্যানার্জি। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানান, মহাশূন্য আসলে শূন্য নয়, এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি। এই সুবিশাল মহাবিশ্বের যেটুকু দেখতে পারি তাহলো বিশাল কসমিক আইসবার্গের সামান্য একটি প্রান্তবিন্দু। এটি মহাবিশ্বের মোট ভর ও শক্তির মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ডার্ক এনার্জি হলো প্রায় ৬৮ শতাংশ এবং ডার্ক ম্যাটার প্রায় ২৭ শতাংশ। যদিও এ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে জানতে পারেনি।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ
মূলত ত্বরণে চলা ভরযুক্ত বস্তুর বিকিরিত তরঙ্গের নাম দেওয়া হয় মহাকর্ষ তরঙ্গ। এ তরঙ্গ শব্দের মতো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। মহাকর্ষ তরঙ্গও স্থান-কালের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে চলে। ২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব দেখিয়ে ছিলেন। এই আবিষ্কারের ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, মহাকর্ষ হচ্ছে বস্তুর ভরের প্রভাবে স্থান-কালের বক্রতা। বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তা বক্রতা তৈরি করবে তত বেশি। এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকরণ মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করার একটি নতুন উপায় খুলে দিয়েছে। এটি বিজ্ঞানীদের মহাজাগতিক ঘটনাগুলো অধ্যয়ন করতে সক্ষম করেছিল। যা আগে থেকে শনাক্ত করা যায়নি।
তথ্যসূত্র : মিডিয়াম ম্যাগাজিন