মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নিরাপত্তায় প্রাইভেট সিকিউরিটি

লাকমিনা জেসমিন সোমা

নিরাপত্তায় প্রাইভেট সিকিউরিটি

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫০০ কোম্পানি ব্যক্তিগত বা কোনো প্রতিষ্ঠানের একান্ত নিরাপত্তায় নির্দিষ্ট অর্থচুক্তির মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের মধ্যে বাড়ছে নিরাপত্তা শঙ্কা। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনীতে থেকেও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে রাজধানীতে একের পর এক খুন-গুমসহ বড় ধরনের চুরি-ডাকাতির ঘটনায় অনেকটা নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে নগরবাসী। এমনকি দুর্বৃত্তের অপকর্মের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ব্যাংক, বীমা, বহুজাতিক কোম্পানিসহ ছোটখাটো দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। আর সে কারণেই নিরাপত্তা জোরদারে নতুন করে প্রসঙ্গ উঠেছে ‘প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস’ কোম্পানিগুলোর ভূমিকা নিয়ে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইভেট সিটিউরিটি সরবরাহকারী এই কোম্পানিগুলোকে আরও শক্তিশালী করে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলে নগরীর নিরাপত্তা রক্ষা সহজ হবে।

দেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচশ কোম্পানি ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তায় নির্দিষ্ট অর্থচুক্তির মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে। যদিও এসব কোম্পানির মধ্যে মোটামুটি ১৫-২০টি বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আগে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোয় এই সিকিউরিটি সার্ভিসের চাহিদা থাকলেও এখন পরিসর আরও বেড়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত বডিগার্ড থেকে শুরু করে পরিবারের বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ ব্যক্তির দেখভালের ক্ষেত্রেও কোম্পানিগুলো তাদের সেবা দিচ্ছে। আর সিস্টেম অনুসারে সেবাগ্রহণকারীরা সরাসরি নিরাপত্তা কর্মীকে বেতন দেওয়ার বদলে ওই কোম্পানি কর্তৃপক্ষকেই সেবার মূল্য পরিশোধ করেন। নিরাপত্তা কর্মীরা বেতন পান তাদের কোম্পানি থেকে যথারীতি মাসিক চুক্তিতে।

বর্তমানে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তায় কাজ করছে জি-৪-এস নামে একটি কোম্পানি। রাজধানীর বারিধারায় অবস্থিত এই কোম্পানি কেবল বাংলাদেশে নয়, কাজ করছে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও। এর ফোর্স বা নিরাপত্তা কর্মীরা বিদেশি দূতাবাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেমন কাজ করছেন, তেমনি কাজ করছেন হাউস কিপিং-এর ক্ষেত্রেও। এ ছাড়া ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, বিমানবন্দরে ভিআইপিদের অভ্যর্থনা ও হাসপাতালে নিরাপত্তার মতো ভিন্ন ভিন্ন কাজেও তাদের দেখা যাচ্ছে।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের করপোরেট শাখায় কর্মরত একজন জি-৪-এস নিরাপত্তা কর্মী বলেন, ৮ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। কোম্পানিতে প্রতিনিয়তই কর্মী বাড়ছে। বিশেষ করে গত ছয় মাসে অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিরাপত্তা সেবা দেওয়ার চুক্তি হয়েছে।

গত ঈদুল ফিতরের আগে সমগ্র রাজধানীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিতে প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ শুরুর ঘোষণা দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে প্রাইভেট সিকিউরিটি কাজ করছে। এ ছাড়া  গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, তেল-গ্যাস ও এনার্জি কোম্পানিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দেখভালের দায়িত্বেও এই কর্মীরা রয়েছেন। রাজধানীর এলিট সিকিউরিটি সার্ভিস বা এলিট ফোর্স নামে পরিচিত কোম্পানিতে গিয়ে জানা গেছে, অন্যান্য সাধারণ নিরাপত্তা সেবার সঙ্গে তারা ট্রাফিক কন্ট্রোল সার্ভিসও দিয়ে থাকে। বর্তমানে ১৬ হাজার কর্মী নিয়ে প্রায় ১৫০০ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছে এই কোম্পানিটি। এর মধ্যে বিদেশি নাগরিকের বাড়ি পাহারার সেবাও দিচ্ছে তারা। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এদের ৯টি শাখা রয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিটি ২০১১ সালে লন্ডনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিকিউরিটির দায়িত্ব পায়।

রাজধানী ঘুরে এমন আরও অনেক কোম্পানির খোঁজ পাওয়া যায়, যাদের কাছ থেকে নগরবাসী ভিন্নধর্মী সব সেবা নিচ্ছে। বহুল পরিচিত সেন্ট্রি সিকিউরিটি সার্ভিস বর্তমানে বডিগার্ড, রোগীর সেবা, ক্যাশ ক্যারিং (টাকা বহন) ছাড়াও শিশুকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশান এলাকার একজন শিল্পপতি জানান, গত তিন মাস হলো তিনি তার দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য প্রাইভেট সিকিউরিটি সেবা নিচ্ছেন। বিনিময়ে তাকে মাসিক প্রায় ২৩ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।

ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা সেবা প্রদান করছে আইসিএল প্রাইভেট লিমিটেড। ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে অবস্থিত এই কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা যে কোনো বাসাবাড়ি বা অফিসে আঙ্গুলের ছাপ পদ্ধতি, ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম (আগুন শনাক্তকরণ), সিসিটিভি ক্যামেরা, অফিসে আগমন ও প্রস্থান রেকর্ডসহ প্রায় ২০ ধরনের ডিজিটাল নিরাপত্তা সেবা দিচ্ছে। এমনকি তারা বিভিন্ন কোম্পানিকে সিকিউরিটি কনসালটেন্সি সেবাও দিয়ে থাকে।

জানা যায়, আশির দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশে প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি যাত্রা শুরু করে। এরপর নব্বয়ের দশকে একযোগে  বেশকিছু কোম্পানি এই ব্যবসা শুরু করে। তবে ২০০১ সালের পর থেকে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে রাজধানীতে কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠা বাড়তে থাকে। সিকিউরেক্স প্রাইভেট লিমিটেড দাবি করছে তারাই প্রথম ১৯৮৮ সালে এ দেশে এ ধরনের সেবা চালু করে।

তবে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও আশুলিয়া, বগুড়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বড় বড় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় এসব কোম্পানির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচনা হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসা নিয়েও। নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন অনেকে। আর সে কারণে কোম্পানিগুলোকে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় নিয়ে এসে এবং নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করতে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর