মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জটিলতায় কাঁচাবাজার স্থানান্তর

লাকমিনা জেসমিন সোমা

জটিলতায় কাঁচাবাজার স্থানান্তর

কারওয়ানবাজারে অবস্থিত এই কাঁচাবাজারটি এখন ডিএনসিসির গলার কাঁটা। দিনশেষে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট সবজির পচা গন্ধে ভারি হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ। দূষিত হয় আশপাশের এলাকা- ছবি: জয়ীতা রায়

ভোর হতে না হতেই ট্রাকবোঝাই শাক-সবজি ও বিভিন্ন মালামাল নিয়ে হাজির হন ব্যবসায়ীরা। শুরু হয় সবজি বিক্রির ধুম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমতে থাকে বাজার। মোটামুটি দুপুরের আগেই বেচা-বিক্রি শেষ করে ফেলেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এরপরই শুরু হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। তাদের বেচা-বিক্রি চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আর এরই মধ্যে মাটিতে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট সবজি, ময়লা-আবর্জনার পচা গন্ধে ভারি হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ। দূষিত হয় আশপাশের এলাকা। রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকার কাঁচাবাজারের এই চিরায়ত দৃশ্য এখন রীতিমতো সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক এলাকার এই বাজারটি ফের স্থানান্তরের দাবি তুলেছেন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। এমনকি খোদ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও এই বাজারটিকে এখন গলার কাঁটা বলে মনে করছে। সরেজমিন দেখা গেছে, কাঁচাবাজার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে জনতা টাওয়ার। এখানেই স্থাপিত হয়েছে দেশের প্রথম সফটওয়্যার পার্ক। গত মাসের ১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এর উদ্বোধন করে গেছেন। অথচ তারপরও এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি টাওয়ারের পাশে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এতবড় একটি বাজারে দিনভর সবজি জমে পচতে থাকে। অথচ যথারীতি টাইম-টেবিলের বাইরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বর্জ্য অপসারণের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে সর্বপ্রথম কারওয়ানবাজারের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এ লক্ষ্যে রাজধানীর মহাখালী, যাত্রাবাড়ী ও গাবতলী সংলগ্ন আমিনবাজারে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য মার্কেটও তৈরি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতায়, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা ভেটো দেওয়ায় তা বানচাল হয়ে যায়। এরপর আর এমন জোরালো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে খুব সম্প্রতি উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক আবারও এ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তিনি বাজার সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। আগের সমস্যাগুলো সমাধানে দুই-একদিন পরপরই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসছেন। আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির মাধ্যমে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছেন। এর আগে গত ১৭ নভেম্বর থেকে কারওয়ানবাজার এলাকার অবৈধ দোকানপাট ও হকার উচ্ছেদে নামে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ যেটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় হাজার সংখ্যক হকার উচ্ছেদ সম্ভব হয়েছে। ডিএনসিসির একটি সূত্র বলছে, অবৈধ দোকানপাটের ব্যাপারে আনিসুল হক অনেকটা কড়া সুরেই ব্যবসায়ীদের বলেছেন, নিজে থেকে সরিয়ে না নিলে, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারওয়ানবাজারের বড় বড় আড়তসহ সম্পূর্ণ কাঁচাবাজারটি সরিয়ে নিতে বেশ কিছু বাস্তব সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যাই কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা। কেননা, ওই এলাকার সব দোকানপাটই সিটি করপোরেশনের কর্তৃত্বে নেই। এর কিছু আছে রাজউকের, কিছু বেসরকারি মালিকানার। ব্যবসায়ীরা লিজ নিয়ে বা টোল পরিশোধের মাধ্যমেই সেখানে ব্যবসা করছেন। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা এ যাবৎ টাকা দিয়ে নিয়ম-নীতি মেনেই ব্যবসার একটি ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করেছি। এখন হুট করে কীভাবে অন্যত্র চলে যাই? ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন একটি জায়গায় খাপ খাইয়ে ব্যবসার আগের অবস্থান ফিরিয়ে নিয়ে আসা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা। যদিও গতকাল উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটি ব্যবসায়িক এলাকা, এখানে আলু-পটোল বিক্রির জন্য জায়গা রাখা হয়নি।’ বাজার স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, মেয়রের নির্দেশে সরানোর প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এটি সম্ভব হবে।  সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনটি পাকা মার্কেট ও কাঁচাবাজারের আড়তসহ গোটা কারওয়ানবাজারে অন্তত দুই হাজার দোকান রয়েছে। আর শুধু কাঁচাবাজারের কথা বলতে গেলে, তার সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৩০০টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের আওতায় পাকা আড়ত ভবনের নিচতলায় ৬৩টি, উপরে ১১৩টি এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান আছে আরও প্রায় ১১৮টি। এ ছাড়া এই বাজারকে ঘিরে আরও বেশকিছু ভাসমান দোকানপাট রয়েছে, যেখানে চা-সিগারেট বা হালকা নাস্তার জন্য খাদ্য-খাবার বিক্রি হয়। বাজার স্থানান্তরের অগ্রগতি বিষয়ে উত্তর সিটির সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-৫) অজিউর রহমান বলেন, গত সপ্তাহেও স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন মেয়র আনিসুল হক। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মেয়রের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। অন্যদিকে মহাখালী, যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজারও ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখন কেবল রাজউক ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করা গেলেই বিষয়টি দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হবে। কেবল কারওয়ানবাজার নয়, রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকাসহ কিছু কিছু স্থানে মূল রাস্তার ওপরে বসা কাঁচাবাজারগুলো উচ্ছেদ বা সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী। তারা বলছেন, রাস্তার ওপরের এসব বাজার কেবল পরিবেশ দূষণই করে না, ঘটায় সড়ক দুর্ঘটনাও। একই অভিযোগ শোনা গেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ছোট-বড় ১৩টি কাঁচাবাজারের বেশ কয়েকটি থেকেও।

কারওয়ানবাজার ঘিরে ডিএনসিসির মহাপরিকল্পনা

ভবিষ্যতে কাঁচাবাজার এলাকার প্রায় ২৪ বিঘা জমির ওপর মিডিয়া পল্লী অথবা করপোরেট পল্লী তৈরির মহাপরিকল্পনা আছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। এর জন্য একটি অত্যাধুনিক কাচ মোড়ানো বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। ১০০ তলা ফাউন্ডেশনে প্রথম অবস্থায় ৩০ তলা এবং পরবর্তীতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়া হলে বাকি তলার কাজ করবেন তারা। কারওয়ানবাজারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন করপোরেট হাউস ইচ্ছা করলে এখানে এক ছাদের নিচে তাদের অফিস বানাতে পারবে।

সর্বশেষ খবর