মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অপরাধের আখড়া রেলস্টেশন

লাকমিনা জেসমিন সোমা

অপরাধের আখড়া রেলস্টেশন

রাজধানীর রেলস্টেশনগুলো। একদিকে হকারদের অত্যাচার, অন্যদিকে চুরি-ছিনতাই ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ যাত্রীরা -ছবি : জয়ীতা রায়

চুরি-ছিনতাই মাদক ও দখলবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে রাজধানীর রেলস্টেশনগুলো। দিনের বেলায় হকারদের অত্যাচার, রাতে চুরি-ছিনতাই ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ রেল যাত্রীরা। এসব নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না তারা। রাজধানীর কমলাপুর, বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন ঘুরে ভুক্তভুগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

তেজগাঁও রেলস্টেশন : তেজগাঁও রেলস্টেশনসংলগ্ন বস্তিতে চলছে রমরমা গাঁজার ব্যবসা। এমনকি সেখানে রেললাইনের ওপর ডালা সাজিয়ে বিক্রি হয় গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। হাট-বাজারে অন্যান্য দ্রব্য বিক্রির মতোই চলে মাদকের কেনাবেচা। বিশেষ করে এই স্টেশনের আশপাশে রেলওয়ের একটি বড় অংশই বস্তি, মার্কেট ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় পুরো এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। খোলাবাজারে মাদক বিক্রির সঙ্গে বস্তিবাসী নারীদের সম্পৃক্ততাই বেশি। অনেকক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদেরও জোরপূর্বক মাদক ব্যবসায় লাগানো হচ্ছে।

তেজগাঁও রেলস্টেশনের মূল প্লাটফর্মগুলোতে দেখা যায়, ময়লা আবর্জনায় ভরে আছে পুরো গ্রাউন্ড। বিশেষ করে রেললাইনের ওপর মলমূত্র ত্যাগের কারণে দুর্গন্ধে পুরো এলাকাজুড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আশপাশের বস্তি এলাকার লোকজনের অবাধ বিচরণে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে স্টেশন।

রাজশাহী থেকে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রূম্পা আক্তার বলেন, আমাদের বাসা তেজগাঁও স্টেশন থেকে রিকশায় ১৫ মিনিটের দূরত্বে। কিন্তু অধিকাংশ সময় বিমানবন্দরে নামি। কারণ, তেজগাঁও স্টেশনে নেমে দুবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি। এজন্য তেজগাঁওয়ে নামার সাহস পাই না। অভিযোগ রয়েছে, তেজগাঁও রেলস্টেশন ঘিরে মাদক-ব্যবসার বিষয়টি জেনেও স্থানীয় থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

বিমানবন্দর রেলস্টেশন : নগরীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। এই স্টেশনের প্রধান সমস্যাই হকার। সেখানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য অবৈধ দোকানপাট। একদিকে সারি সারি স্টেশনারিজ শপ, অন্যদিকে প্লাটফর্মজুড়ে মালামালের পসরা সাজিয়ে বসেছে ভাসমান হকার। এসব স্টেশনারিজ শপের বিরুদ্ধে খাবারের গলা কাটা দাম রাখার অভিযোগ রয়েছে। দোকানপাট ছাড়াও এই রেল স্টেশনের চারপাশে রয়েছে অর্ধশতাধিক ভ্রাম্যমাণ হকার। হকারদের ভিড়ে সাধারণ যাত্রীদেরই পা রাখার জায়গা নেই। রেল লাইনের দুই পাশের প্লাটফর্মে যাত্রীদের বসার বেঞ্চিতে কোনো যাত্রীই বসার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিশেষ করে প্রতিটি পিলারের গোড়ায় গোলাকৃতি বসার জায়গায় যাত্রীর পরিবর্তে বসে থাকে হকাররা। কোনো কোনো বসার জায়গা দখল করে আছে ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবী ও ছিন্নমূল অপ্রকৃতস্থ মানুষ।

রাজধানীর অন্য রেলস্টেশনের মতো এই স্টেশনেও রয়েছে দূষণ সমস্যা। রেলস্টেশনে ঢুকে ডান দিকে প্রথম ও শোভন শ্রেণির বিশ্রামাগার থাকলেও অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে সেখানে বসতে চান না যাত্রীরা। এমনকি অগ্রিম ও সাধারণ টিকিট কাউন্টারের সামনেও  যাত্রীরা কাপড় দিয়ে নাক চেপে ধরে টিকিট কেনার অপেক্ষায় থাকেন। বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহারের সুযোগ পান না যাত্রীরা। সেখানেও হকার ও মাদকসেবীদের রাজত্ব। সন্ধ্যার পর এই ব্রিজটি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্টেশনে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তাকর্মীরা উদ্বাস্তু ব্যক্তিদের সরিয়ে দিলেও তারা আবার স্টেশনে ঢুকে পড়েন। ফলে মাঝে-মধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। তখন তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় পুলিশ।

গত জুলাইয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক স্টেশন পরিদর্শনে এসে যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে স্টেশন মাস্টার হরিপদ দাশকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই স্টেশনের প্রথম  শ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রামাগারের দুটি বাথরুম অপরিচ্ছন্ন থাকায় দুর্গন্ধে স্টেশনের ভিতরে অবস্থান করাই দায় হয়ে পড়ে।

কমলাপুর রেলস্টেশন : কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, অন্যান্য স্টেশনের তুলনায় এই স্টেশনে হকারদের দৌরাত্ম্য কম। তবে রেলস্টেশনের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে উত্তর দিকে বা ৭/৮ নম্বর প্লাটফর্মের পাশে দেখা গেছে কিছু মাদকসেবী ঝিমুচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে প্লাটফর্মসংলগ্ন এই রেলস্টেশন ভাগাড়ে পড়ে থাকা অকেজো রেলের বগি ঘিরে নানা অপরাধ সংঘটিত হয়। সন্ধ্যার পর এখানে মাদকসেবীদের আসর বসে। ভাগাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়া ফুটওভার ব্রিজটিও যাত্রীদের জন্য নিরাপদ নয়। তারপরও স্টেশনসংলগ্ন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় দিনের বেলায় এই ব্রিজ দিয়ে স্কুল শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করে। কমলাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন ‘শহরতলি স্টেশন’ এর চিত্র রাজধানীর বাকি দুই রেলস্টেশনের মতোই নোংরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর