মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্কুল-কোচিংয়ে পেরেশান মায়েরা

জিন্নাতুন নূর

স্কুল-কোচিংয়ে পেরেশান মায়েরা

বাচ্চাদের স্কুল-কোচিংয়ে হাজিরা দিতে গিয়ে নিত্য পেরেশানিতে মায়েরা ছবি : জয়ীতা রায়

সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এবং তাদের ভালো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে বর্তমান সময়ে অভিভাবকদের বলা যায় এক প্রকার যুদ্ধে নেমেছেন। বিশেষ করে এ ব্যাপারে গৃহিণী ও কর্মজীবী মায়েদের আন্তরিকতার শেষ নেই। ঘরের কাজের বাইরে একজন মা, স্কুল, কোচিং এবং নাচ-গানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণমুখী শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিনের প্রায় পুরো সময়টাই তার সন্তানের পেছনে ব্যয় করছেন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি সন্তানের পড়ালেখার তদারকি করার দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। সব মিলিয়ে একজন মায়ের কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয় সেই ভোর থেকে যা চলে সন্তান ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। আর সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে গিয়ে এই মায়েরা তাদের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি অবিচার করছেন। নিজের যত্নের প্রতি তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন। অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া ও যথাযথ বিশ্রাম গ্রহণ না করায় এবং বাইরের খাবার খাওয়ায় তারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এর ফলে এই মায়েরা উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ, আলসার, ডায়াবেটিস, রক্ত ও পানিশূন্যতা, পেটের পীড়া,  গ্যাস্ট্রিক ও মাথা ঘোরা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।  

রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা যায়, স্কুল ছুটির আগে সন্তানদের নিয়ে আসা অভিভাবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী অর্থাৎ মা। এদের মধ্যে যেমন আছেন কর্মজীবী নারী তেমনি আছেন গৃহিণীরাও। কর্মজীবী নারীরা সন্তানকে স্কুলে দিয়ে কাজে চলে যান। এরপর পরিবারের অন্য সদস্য সন্তানকে নিতে আসেন বা স্কুলের যানবাহনের সাহায্য নেন। কেউ আবার নিজেও সন্তানকে স্কুল ছুটির পর নিতে আসেন।

অন্যদিকে গৃহিণী মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে মায়েরা দূর থেকে সন্তানকে নিয়ে স্কুলে আসেন এবং যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই বা তারা স্কুলের গাড়ির টাকা খরচ করতে আগ্রহী নন তারা স্কুল ছুটি হওয়া পর্যন্ত স্কুলের বাইরেই সন্তানের অপেক্ষায় থাকেন। আবার যেসব মায়েদের একটির বেশি সন্তান ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে পড়ছে তাদের ভোগান্তি আরও বেশি। এক সন্তানকে স্কুলে রেখেই অন্য সন্তানকে স্কুলে রাখার জন্য ছুটতে হয়। ফলে তার আরও বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

ঢাকার উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল, মনিপুর স্কুল এবং গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলের বাইরে দেখা যায়, সন্তানের জন্য অপেক্ষায় থাকা অভিভাবকরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে বসে আছেন। যেসব স্কুলে অভিভাবকদের জন্য ছাউনি আছে তারা এর নিচে বসেন আর যেসব স্কুলে ছাউনি নেই কিংবা ছাউনিতে স্থান সংকুলান হয় না তারা পাশেই চাদর বা কাগজ বিছিয়ে বসেন। এ সময় গল্পগুজব ছাড়াও সময়টা কাজে লাগাতে তাদের কেউ কেউ নকশিকাঁথা বুনে তা বিক্রি করেন। কেউ কাপড়ের ব্যবসা করেন। কেউবা ঘরে বানানো বিভিন্ন খাবার এনে তা বিক্রি করেন।

উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের সামনে সন্তানের জন্য অপেক্ষায় থাকা এক মা নাসিমা আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সন্তানের বাবা সকালেই অফিসে চলে যান। সন্তানকে নাস্তা খাইয়ে টিফিন তৈরি করে প্রতিদিন আমিই স্কুলে নিয়ে আসি। আবার স্কুল ছুটি হওয়া পর্যন্ত স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করি। এ সময় সংসারের সচ্ছলতা আনতে ব্লকের থ্রি-পিস কাপড়ের ব্যবসা করি। অন্য অভিভাবকদের মায়েরাই এই কাপড়  কেনেন। রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের আরেক শিক্ষার্থীর মা জানান, এই স্কুলের বাইরে অভিভাবকদের জন্য ছাউনি নেই। এতে রোদ-বৃষ্টিতে তাদের কষ্ট হয়। স্কুলের বিপরীতে গণভবন হওয়ায় সেই এলাকার আশপাশে কোথাও বসার ব্যবস্থাও নেই। তিনি জানান, সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে ছুটির দিন ছাড়া এখন অন্যান্য দিনে অধিকাংশ সময় রাস্তাতেই তার দিন কাটে।

এই মায়েদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, স্কুল ছুটির পর আবার বাসায় গিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শেষে বিকালে সন্তানকে কোচিং বা নাচ-গান বা ড্রয়িং স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। সেখানেও আবার অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এতে দিনের অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরে সন্তানের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে মায়েদের। রাতে ঘরে ফিরে আবারও সংসারের কাজ ও সন্তানের লেখাপড়ার তদারকি এই মায়েদেরই করতে হচ্ছে। সন্তানের লেখাপড়ার তদারকি করতে গিয়ে একেবারে পেরেশান মায়েরা।

দীর্ঘ সময় বাইরে থেকে নানারকম অনিয়মের কারণে তারা অনেকেই শারীরিক মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে মায়েরা সন্তানের জন্য স্কুলের বাইরে অপেক্ষায় থাকেন, তারা বাইরে ধুলাবালিতে কাগজ বিছিয়ে বসেন। সেটি স্বাস্থ্যকর নয়। তারা ঠিকমতো পানিও পান করেন না। বাইরের খাবার খান। এতে তাদের নানারকম শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে পানিশূন্যতা, রক্তশূন্যতা, পেটের সমস্যা, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক এবং ওজন কমে যাওয়ার সমস্যা বেশি হয়।

সর্বশেষ খবর