শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরবাসী

জিন্নাতুন নূর

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরবাসী

অতিরিক্ত ওজন কমাতে অনেকেই নিয়ম করে পার্কে ঘাম ঝরান ছবি: রোহেত রাজীব

শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম না করা, খেলাধুলা না করা, অস্বাস্থ্যকর খাবার যেমন-ফাস্টফুড ও ক্ষতিকর কোমল পানীয় পান করে শহরের মানুষ ক্রমেই স্থূল হয়ে যাচ্ছেন। আর মুটিয়ে যাওয়ার এই হার নারী-পুরুষ ও শিশু সকলের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, গ্রামের তুলনায় শহর আর উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের স্থূল হওয়ার হার বেশি। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থূলতার কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় জানা যায়, গত ৩৩ বছরে দেশের মানুষের স্থূলতার হার দ্বিগুণ হয়েছে। ১৯৮০ সালে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে স্থূলতার হার ৭ শতাংশ এবং শিশুদের ৩ শতাংশ ছিল। ২০১৩ সালে তা বেড়ে যথাক্রমে ১৭ শতাংশ এবং ৪.৫ শতাংশ হয়েছে। আর এই প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ৪ শতাংশ ক্রমেই আরও স্থূল হচ্ছেন বলে গবেষণায় জানানো হয়। গবেষণাটি স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়। এ ব্যাপারে আইসিডিডিআরবির সহযোগী গবেষক ড. আলিয়া নাহিদ জানান, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন স্থূল। স্থূলতা কমানোর জন্য আমাদের এখনই চিন্তা করতে হবে।

আইসিডিডিআরবির আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন স্থূলকায় বা অধিক ওজনের। এতে দেখা যায়, সম্পদ সূচক, শিক্ষার অবস্থা, টেলিভিশন দেখার সময়কালের মতো বেশকিছু কারণ এই স্থূলতার জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর কমপক্ষে ২৮ লাখ মানুষ অধিক ওজন এবং স্থূলতার কারণে মারা যায়। বিশেষ করে নারীদের জন্য স্থূলতা নানাভাবে ক্ষতির কারণ হয়। এজন্য নারীরা ডায়াবেটিস, স্তন, জরায়ু-মুখ ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। এই গবেষণায় ১৬ হাজার ৪৯৩ নারীর মধ্যে ১৮ শতাংশই ছিলেন অধিক ওজনের। এতে দেখা যায় যে, শহরে বসবাসরত নারীদের মধ্যে শারীরিক পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত নারীদের চেয়ে পূর্ণ মাত্রার কর্মজীবী নয় এমন নারীরা অধিক ওজন এবং স্থূল হওয়ার দেড়গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। শহর ও গ্রাম উভয় জায়গায় ধনী ও খাদ্য সুরক্ষিত পরিবারের নারীরা অধিক ওজন এবং স্থূল হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। গ্রামের চেয়ে শহর এলাকার মানুষের মধ্যে ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি। 

আইসিডিডিআরবির পুষ্টি ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক এবং এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, স্থূলতার উচ্চমাত্রা আমাদের দেশের চিকিৎসা বাজেটে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মোকাবিলা করা না গেলে অধিক ওজন এবং স্থূলতায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ, হৃদরোগ ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে।

এছাড়াও শিশুদের চটকদার খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে এখন বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। যা দেখে অস্বাস্থ্যকর এ খাবারগুলোর প্রতি শিশুদের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা যায়, শহরের ১৭.৯% স্কুলে যাওয়া শিশু অতিরিক্ত ওজনের তথা স্থূল। বিশেষ করে ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের ২৭.৭%ই স্থূল। স্থূল শিশুদের মধ্যে ২৭ শতাংশ ধনী পরিবারের এবং ৪ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের। ঢাকা ও চট্টগ্রামে স্থূল শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেশে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা খুবই সীমিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মাওলা বলেন, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে মানুষ এখন সহজেই ফাস্টফুডে আকৃষ্ট হচ্ছে। ফাস্টফুডে কার্বোহাইড্রেড ও তেলের পরিমাণ বেশি। এটি খেয়ে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং লিভারও সঠিকভাবে কাজ করে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন. ফাস্টফুড স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ফাস্টফুড খাওয়ার সঙ্গে ওজন বাড়ার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ফাস্টফুডের ক্ষতিক্ষর প্রভাব এড়াতে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেই।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, এখন গৃহিণী-কর্মজীবী নারী পুরুষ সকলেই প্রচুর ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাচ্ছেন। কাজের জন্য ঘরের বাইরের খাবার খাওয়ায় এমনটি হচ্ছে। এমনকি সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেক অভিভাবকও ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাচ্ছেন। কিন্তু তারা যে হারে ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাচ্ছেন সে হারে শারীরিক পরিশ্রম করছেন না। আর উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবারের প্রভাবে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে তারা স্থূল হয়ে পড়ছেন। পুষ্টিবিদরা জানান, উচ্চমাত্রার ক্যালরি, চর্বি, সম্পৃক্ত চর্বি, চিনি ও লবণ স্থূলতার জন্য দায়ী। খাদ্যের এ উপাদানগুলোতে পুষ্টিগুণ কম থাকে। কিন্তু স্বাদগ্রন্থির গঠনের কারণে মানুষ চর্বি, চিনি ও লবণযুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করে। এসব খাবার শরীরে মেদ জমে যাওয়ায় ভূমিকা রাখে। চিকিৎসকরা জানান, স্থূল ব্যক্তিরা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় খেলাধুলা বা শারীরিক কাজেও কম অংশ নেন। ফলে, তাদের স্থূলতা বাড়তেই থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর