মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?

রফিকুল ইসলাম রনি

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?

সিএনজিচালকরা স্বল্প দূরত্বসহ যে কোন গন্তব্যে যেতে চায় না। মিটার উপেক্ষা করে দ্বিগুণ ভাড়া হাকে যাত্রীদের কাছে। তাদের অজুহাতের শেষ নেই ছবি : জয়ীতা রায়

রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। সরকারের প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে সিএনজি চালকরা চরম স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছেন। সিএনজি অটোরিকশা নীতিমালা-২০০৭ অনুযায়ী, সিএনজি চালক স্বল্প দূরত্বসহ নির্ধারিত এলাকার মধ্যে যে কোনো দূরত্বে যেতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু বাস্তবে রাজধানীর কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালকই স্বল্প দূরত্বে এবং যাত্রীর চাহিদামতো গন্তব্যে যেতে চান না। তাদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে যাত্রীর যাত্রার সবকিছু। যাত্রীর গন্তব্য চালকের পছন্দ না হলে তাকে কোথাও নেওয়া যায় না। যাত্রী উপেক্ষা করার এই ঔদ্ধত্য চালিয়ে আসছেন সিএনজি চালকরা। ইতিমধ্যে সরকারিভাবে সিএনজির ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও মিটারে যায় না সিএনজি। দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বসে যে কোনো গন্তব্যে। যাত্রী উপেক্ষা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেন বলছে, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’ বরেণ্য কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে থাকলে হয় তো তার এই শিরোনামের কবিতাটি ঢাকার সিএনজি চালকদেরই উৎসর্গ করে যেতেন।  

সিএনজি নীতিমালায় বলা আছে, সিএনজি অটোরিকশা চালক-মালিকদের মিটার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ঢাকার চালক মিটারের কথা ভুলেই গেছে। তারা এখন মিটারে যায় না, চুক্তিতে চলে। 

রাজধানীর মধুবাগ হাতিরঝিল থেকে হাসিবুল হাসান যাবেন বনানীতে। অনেক অপেক্ষার পর একটি সিএনজি অটোরিকশা পেলেন। মিটারে ভাড়া ৮০-১০০ টাকা উঠতে পারে। কিন্তু অটোরিকশা চালক দাবি করলেন ২৫০ টাকা। মৃদু আপত্তির পর তাতেই রাজি হলেন যাত্রী। বললেন, অতিরিক্ত ভাড়া না দিয়ে উপায় নেই। আমরা জিম্মি হয়ে আছি তাদের কাছে। 

এদিকে এক লাফে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়ানোর এক বছর পরও এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তারা এক প্রতিবেদনে বলেছে, সিএনজি চুক্তিতে চলে ৮৬ ভাগ, বখশিশ দাবি করে ৯৭ ভাগ, মাসে প্রায় ১২ কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য চলে সিএনজি অটোরিকশা খাতে। 

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সিংহভাগ অটোরিকশা যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যায় না, মিটারে চলে না, মিটারে গেলেও অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। নগরীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, গুলিস্তান, সদরঘাট, প্রেসক্লাব, পল্টন, ফার্মগেট, কলাবাগান, মহাখালী, মালিবাগ, রামপুরা, মিরপুর-১১, মিরপুর-১২, আগারগাঁও, গাবতলী, জুরাইন রেলগেট, পোস্তগোলা, আবদুল্লাহপুর, বাড্ডা, এয়ারপোর্ট, উত্তরা, শ্যামলী, খিলগাঁও, মগবাজার, নাবিস্কো, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, ডেমরা, ভাটারা, বনানী, কাকলী, গুলশান-১, গুলশান-২, শাহজাদপুর, বারিধারা, শাহবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডি, জিগাতলায় গত ১০ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী প্রায় ২ হাজার ১৬৬টি অটোরিকশার ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে।

এতে দেখা যায়, এসব এলাকায় চলাচলকারী অটোরিকশার ৮৬ ভাগ চুক্তিতে চলাচল করছে। যারা মিটারে চলে তাদের ৯৭ ভাগ ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া (বখশিশ) দাবি করছে।

এ ছাড়াও যাত্রী পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮২ শতাংশ অটোরিকশা। জরিপকালে যাত্রীর ইচ্ছায় চুক্তিতে চলতে দেখা গেছে ২২ শতাংশ অটোরিকশা।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মতিঝিল থেকে গুলিস্তান ১০০ টাকা, সদরঘাট থেকে ধানমন্ডি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, কমলাপুর থেকে ফার্মগেট ২০০ টাকা, প্রেসক্লাব থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, প্রেসক্লাব থেকে বসুন্ধরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, শাহবাগ থেকে কলাবাগান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, সদরঘাট থেকে বাড্ডা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, মহাখালী থেকে যাত্রাবাড়ী ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বাড্ডা থেকে ধানমন্ডি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, রামপুরা থেকে গুলিস্তান ২৫০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা, সদরঘাট থেকে গাবতলী ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, সদরঘাট থেকে মিরপুর ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, সদরঘাট থেকে পল্লবী ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা ভাড়ায় চুক্তিতে চলতে দেখা গেছে। অথচ এসব পথে মিটারে যাতায়াত করলে কোনো কোনো গন্তব্যে এসব চুক্তিকৃত ভাড়ার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়ায় যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারত।

পর্যবেক্ষণে আরও জানা গেছে, প্রতিটি অটোরিকশার সরকার নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকা হলেও সিংহভাগ মালিক এক হাতে বা এক চালক দিয়ে দৈনিক ১০৫০ টাকা এবং দুই শিফটে বা দুজন চালক দিয়ে দুই বেলায় দৈনিক ১৪০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত জমা আদায় করছেন। 

জানা গেছে, সিএনজি মিটারে চলছে কিনা তা দেখতে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মনিটরিং টিম প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তারা জানান, মনিটরিং টিমের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশকে সম্পৃক্ত   করার বিকল্প নেই। কারণ, এক্ষেত্রে হাত বাড়ালেই ট্রাফিক পুলিশের নাগাল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু মনিটরিং টিম খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর