মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্কুলভ্যানে ঝুঁকির যাত্রা

জিন্নাতুন নূর

স্কুলভ্যানে ঝুঁকির যাত্রা

গাদাগাদি করে শিশুদের নিয়ে চলাচলকারী স্কুলভ্যানগুলো যে কোন সময় বড় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে —জয়ীতা রায়

রাজধানীর মিরপুর কাজীপাড়ার একটি স্বনামধন্য স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আদ্রিতা। মিরপুর ১১ নম্বর বাসা থেকে আদ্রিতা স্কুলে যায় ভ্যানগাড়িতে করে। প্রথমদিকে আদ্রিতার মা তাকে রিকশা করে স্কুলে পৌঁছে দিত এবং নিয়েও আসত। কিন্তু আদ্রিতার ছোটভাই জন্ম নেওয়ার পর বাধ্য হয়ে আদ্রিতার স্কুলে যাওয়ার জন্য তার অভিভাবকরা স্কুলভ্যানের সাহায্য নেন। তবে এই স্কুলভ্যান স্কুল কর্তৃপক্ষের নয়। খাঁচাসদৃশ ছোট লোহার স্কুলভ্যানে গাদাগাদি করে আদ্রিতা তার সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যায়। ফেরার পথে স্কুলভ্যানে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে তর্কে জড়ালে আদ্রিতাকে প্রায়ই ভ্যানচালকের ধমক খেতে হয়। এ ছাড়া ভ্যানচালককে ধীরগতিতে ভ্যান চালাতে অনুরোধ করলেও শিক্ষার্থীদের কথা কানে তোলেন না চালক। আর দ্রুতগতিতে ভ্যান চালানোর জন্য প্রায়ই ঝাঁকুনি খেয়ে ভ্যানের ভিতরে থাকা শিশুরা আঘাত পায়। এমনকি বাড়িতে গিয়ে এই শিশুরা যাতে তাদের অভিভাবককে এ বিষয়ে অভিযোগ করতে না পারে সেজন্য ভ্যানচালক তাদের শারীরিক নির্যাতনেরও ভয় দেখায়।

আদ্রিতার মতো রাজধানীর অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষার্থীদের নেই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা আছে। কোনো কোনো নামিদামি স্কুলের মাইক্রোবাস থাকলেও শিক্ষার্থী অনুপাতে মাইক্রোবাস না থাকায় সেখানে শিক্ষার্থী পরিবহনে স্কুলভ্যানও ব্যবহৃত হয়। উচ্চবিত্ত অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে প্রাইভেট কার ব্যবহার করলেও মধ্যবিত্তদের অধিকাংশের সন্তানকে আনা-নেওয়ার জন্য স্কুলভ্যানের ওপরই নির্ভর করতে হয়। ব্যস্ত সড়কে অন্য ভারী যানবাহনের ভিড়ে এসব স্কুলভ্যান অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের পরিবহন করে। ফলে যে কোনো সময় বড় রকমের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার ভ্যানচালক সজীব মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক গ্যারেজ মালিকের গাড়ি আমি ভাড়ায় চালাই। মাস শেষে গ্যারেজ মালিক আমাকে ৮ হাজার টাকা দেন। আর সারা দিনে চার থেকে পাঁচবার শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে বাসায় আনা-নেওয়া করি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসিক চুক্তিতে এই ভ্যানচালকরা রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে স্কুলে আবার স্কুল ছুটির পর বাসায় পৌঁছে দেয়। তবে অপর্যাপ্ত আসনের জন্য শিক্ষার্থীদের এই ভ্যানে কিছুটা চাপাচাপি করেই বসতে হয়। আর লোহার খাঁচায় তৈরি ভ্যানের অনেকগুলোতে পর্দা না থাকায় রোদ-বৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট পোহাতে হয়। এই ভ্যানগুলোর কিছু আছে প্যাডেলচালিত আর কিছু মোটরচালিত। অন্যদিকে ভ্যানের গায়ে শুধু ভ্যানচালকের নাম ও মোবাইল নম্বর ছাড়া বিস্তারিত তথ্য না থাকায় সন্তানদের অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পাঠানোও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ভ্যানগাড়ি শিক্ষার্থীদের নিজ বাসার দোরগোড়ায় নামিয়ে দেওয়ায় স্কুলবাসের চেয়ে স্কুলভ্যানের প্রতি অভিভাবকদের আস্থা বেশি থাকে। অন্যদিকে স্কুলবাসে একজন শিক্ষার্থীকে অনেকক্ষণ সময় অবস্থান করতে হয়। এ জন্য উচ্চবিত্ত তো বটেই, এমনকি মধ্যবিত্তরাও কষ্ট করে অর্থ জমিয়ে সন্তানকে প্রাইভেট গাড়িতে করে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী। কিন্তু এর ফলে নগরে ভয়ঙ্কর যানজটও তৈরি হয়।

তবে স্কুলভ্যান ছাড়াও রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে আরও বহু শিক্ষার্থীকে স্কুলে যাতায়াত করতে দেখা যায়। অনেক কিশোর শিক্ষার্থী আছে যাদের লেগুনার পাদানিতে করেই যাতায়াত করতে দেখা যায়। অনেক শিশু শিক্ষার্থীও লোকাল বাসে করে গন্তব্যে যায়। আবার অনেককে বিআরটিসির দোতলা বাসেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াত করতে দেখা যায়। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য ঢাকায় বিআরটিসি ২০১১ সালে ১৪টি স্কুলবাস নামায়। সে সময় নগরীর ২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বহন করত এই স্কুলবাস। কিন্তু লোকসানের ফলে তিন মাসের মাথায় এর বেশির ভাগ বাসই সেবা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে মিরপুর ১২ থেকে আজিমপুর পর্যন্ত মাত্র দুটি স্কুলবাস চলছে।

নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের বহনে ব্যবহৃত স্কুলভ্যানগুলো সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে চলে না। এগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট স্কুলের নাম ভাঙিয়ে চলে। ভ্যানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এর কোনো বিকল্প নেই বলেই অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের বহনে এটি ব্যবহার করছেন। কিন্তু যদি এলাকাভিত্তিক স্কুলব্যবস্থা চালু করা যায়, যেখানে একটি এলাকার শিক্ষার্থী সেই এলাকার স্কুলেই শিক্ষা নেবে তাহলে সে হেঁটেই স্কুলে যেতে উৎসাহিত হবে।

সর্বশেষ খবর