বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

দখলে সংকুচিত পল্টন ময়দান

রফিকুল ইসলাম রনি

দখলে সংকুচিত পল্টন ময়দান

পল্টন ময়দানে ক্রীড়া স্থাপনা ও দখলে সংকুচিত ময়দান ছবি : রোহেত রাজীব

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অনেক রাজনীতিক তাদের আগুনঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে এই মাঠ কাঁপিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে নতুন দেশের জন্ম ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এই মাঠ পরিচিত। ‘ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়েছে’ এই শব্দটি কানে বাজলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল একটা খোলা মাঠ। কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্যের মাঠ আর নেই। এখন মাঠের চারদিকে বড় বড় স্থাপনা উঠে মাঠটি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। দখলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে পল্টন ময়দান। তিন কোণে তিনটি ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। মাঝখানে এক চিলতে জায়গা থাকলেও সেখানে এখন খেলা হয় না। এক সময়ে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের এই স্থানটি এখন ছোট হতে হতে মধ্যম সারির মাঠ হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি একের পর এক স্থাপনা উঠছেই। সম্প্রতি যোগ হয়েছে বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশন কমপ্লেক্স।

রাজধানীর গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামের মাঝখানে ছোট একটি মাঠের মতো। সরেজিমন দেখা গেছে, মাঠের চারদিকে গ্রিলে রং করা হচ্ছে। মাঠের এক অংশে নির্মাণকাজের বিভিন্ন সামগ্রী রাখা। পাশেই বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশন। মাঠের চারদিকে হ্যান্ডবল, ভলিবল, বক্সিং, কাবাডিসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের অফিস। মাঠটি এখন খেলা অনুশীলনের জন্য ব্যবহূত হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি একরকম বন্ধই।

বাঙালি মানসে পল্টন ময়দানের পরিচয়— জনসভা, অধিকার আদায়ের দাবিতে যুতবদ্ধ মানুষের তীব্র নিনাদ তোলা কণ্ঠধ্বনি। এর নামের আদ্যে জুড়ে আছে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দবন্ধটি। রাজনীতির সঙ্গে এর মিতালি কিংবদন্তির মতো। পল্টন ময়দান আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনায়। এক চিলতে মাঠ ছাড়া এখানে আর কোনো খালি জায়গা নেই। মাঠের পশ্চিম পাশে যে খালি জায়গা এতদিন ব্যবহার হতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য, সেখানে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স। 

ফুটবল, ক্রিকেট, হকি কিংবা অন্য কোনো জনপ্রিয় খেলা নয়, পার্কিংয়ের জায়গাটা ঢুকে গেল অখ্যাত রোলার স্কেটিংয়ের পেটে। সৌভাগ্যই বলা যায়- এ ফেডারেশনের ১৮ কোটি টাকা ব্যয় তাদের জন্য কমপ্লেক্স নির্মাণে। যদিও সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, ভলিবল, কারাতে, তায়কোয়ানদোসহ বিভিন্ন খেলা হবে এখানে। 

এই ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’ জানিয়ে ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নানা দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা দিয়েছেন এখান থেকে। ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতনের পর নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয় পল্টন ময়দান। ঢাকার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্মারক এ ময়দানটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুই নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় পরস্পরবিরোধী আন্দোলনে জনশক্তি ‘শোডাউন’ ভেন্যু হিসেবে বেছে নেন। ইতিহাস বলছে, পল্টনে ছিল জলা-জঙ্গল। গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া রেলগেটের উত্তরে ঢাকা নগরীর বিকাশ শুরুর পর পল্টন এলাকা ক্রমান্বয়ে লোকালয় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত পল্টন ময়দান ছিল দেশের খেলাধুলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭৮ সালে বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী ক্লে বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে পল্টন ময়দানেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তৈরি করা হয়েছে বক্সিং স্টেডিয়াম। এক পর্যায়ে পল্টন ময়দানকে বিভিন্ন শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকার রাজপথে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার জন্য নিত্যদিন শহরে যানজট সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি হতো। সে অবস্থা থেকে রেহাই পেতে তৎকালীন ঢাকার সিটি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ পল্টন ময়দানকে সিটি করপোরেশনের অধীনে নিয়ে জনসভা, সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে ঘোষণা দেন। পল্টন খ্যাতি পায় রাজনীতির ময়দান নামে। ওয়ান  ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর এই ময়দানকে আবারও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু পল্টন ময়দানকে সংরক্ষণ ও পরিচর্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু পল্টন ময়দানকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য ও অবয়ব বিনষ্ট করা হয়। সন্ধ্যার পর পল্টন ময়দান এলাকাটি সমাজবিরোধী, দুর্বৃত্ত, ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক ময়দানকে এখন আর চেনার উপায় নেই।

সর্বশেষ খবর