মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নগরে বাড়ছে ঘুমের কষ্ট

জিন্নাতুন নূর

নগরে বাড়ছে ঘুমের কষ্ট

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যানজটে এরকম দৃশ্য এখন নিত্যদিনের কর্মজীবীদের। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে নিত্যদিনের ভোগান্তি ছবি : জয়ীতা রায়

‘জাগরণে যায় বিভাবরী

আঁখি হতে ঘুম নিল হরি

মরি মরি।’

নির্ঘুম নিশি যাপন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আকুলতা বাঙালি মানসে স্পষ্ট হয়ে আছে। ঘুম নিয়ে আমাদের নির্মলেন্দু গুণের আকুলতাও কম নয়। তিনি কবিতায় বলেছেন—

‘হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক

এই অসহ রাত্রির। আমি আর সইতে পারছি না

...চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও

আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?

লক্ষ্মীসোনা, মণি আমার, একটু ঘুমাও।

...দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে

আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে।’

ঘুম জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হয় আমাদের প্রতিদিন। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটাতে হয় ঘুমিয়ে। ৬০ বছরের জীবনে ২০ বছর কেটে যায় ঘুমে। নাগরিক জীবনে হাজারো রকমের জটিলতায় ঘুমের কষ্ট বাড়ছে ক্রমশ। নগরের মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে পারছে না।  

নাগরিক জীবনে আমরা অনেক সময় থাকি নিদ্রা ও জাগরণের সীমান্তে। নানা কারণেই আমাদের ঘুম হয় না। জেগে জেগে কাটে রাত। চোখের পাতা এক হয় না। দুশ্চিন্তা, আর্থিক অনটন, অফিসের কাজ, পরীক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, হুমকি, সন্ত্রাস অনেক কারণেই নির্ঘুম রাত কাটে। ‘ভালোভাবে ঘুমান, জীবনের যত্ন নিন’ এ স্লোগানে গত ১৭ মার্চ পালিত হলো বিশ্ব ঘুম দিবস।

বেসরকারি অফিসের হিসাবরক্ষক শাহরিয়ার আলম। প্রতিদিন পল্টনের কর্মক্ষেত্রে যেতে সকাল ৮টায় মিরপুর ১২ নম্বর থেকে বাসে উঠতে হয় তাকে। এই পথ পাড়ি দেওয়া তার কাছে এখন দুঃস্বপ্নের। যানজটে বাসেই তাকে ২ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। ফেরার পথেও একই দুর্ভোগ। এতে প্রায়ই কর্মস্থলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। হজম করতে হয় অফিসে বসের ঝাড়ি। সকালের যানজট ও অফিসে দেরিতে যাওয়ার ভয়ে প্রায়ই রাতে আতঙ্কে ঘুম আসে না শাহরিয়ারের। রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেন। ঘড়ি দেখেন একটু পরপর। এতে ঘুম পূর্ণ না হওয়ায় সকালে বাসে ও অফিসে বসে ঝিমাতে থাকেন তিনি। তার মতো ঢাকার যানজটের কারণে সমস্যায় পড়েছেন অসংখ্য কর্মজীবী। ঢাকায় যানজট তো আছেই, তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেলের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। আছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নিত্যনতুন নাগরিক যন্ত্রণা। কেউ সন্তানকে কলেজে পাঠিয়ে দিনভর দুশ্চিন্তায় কাটান। কারও বেতনের টাকায় সংসার চলছে না। কেউ বাড়ির কাজে হাত দিয়ে চাঁদাবাজের হুমকিতে পড়েছেন। কারও রান্নার চুলায় গ্যাস আসছে না। কেউ আবার সুপেয় পানির কষ্টে ভুগছেন। ঘুম আসবে কী করে? নগরের মানুষের ঘুম ও বিশ্রামের সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ এখনো শেষ না হওয়ায় এবং মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে যানজট দুঃসহ হয়ে উঠেছে। যানজটের কারণে গণপরিবহনের যাত্রীদের যাতায়াত সময় অনেক বেড়ে গেছে।

যানজটে পড়ে বাড়ি ও গাড়িতে বসেই অনেককে ঘুমাতে দেখা যাচ্ছে। কর্মজীবীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে নিত্যদিনের এই ভোগান্তি। রায়েরবাজারে কর্মরত ব্যাংক কর্মকর্তা শাহানা মাহমুদ বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাতে সংসারের কাজ সেরে সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে যখন নিজে ঘুমাতে যাই তখন পরের দিন অফিসে যাওয়ার ভোগান্তির কথা ভেবে আর ঘুম আসে না।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা, যাদের প্রতিদিন সময় মেনে কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে হয়। তাদের দেরিতে কাজে গেলে জবাবদিহি করতে হয়। এ থেকে তার মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। যানজটে অনেকক্ষণ বসে থাকলে মানুষের শরীর থেকে এক ধরনের টেনশনজনিত হরমোন নিঃসৃত হয়। শরীরে তখন এক ধরনের বায়োক্যামিস্ট্রি তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কও ঠিকমতো কাজ করে না।

দীর্ঘদিন এ পরিস্থিতি থাকলে বিভিন্ন শারীরিক রোগের পাশাপাশি হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস হয়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জখম তৈরি হয়। স্থায়ী অনিদ্রা দেখা দেয়।

সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা-প্রাণহানির বড় কারণ চালকের চোখে ঘুম। রাজধানীতে তরুণ পেশাজীবীদের বড় অংশ মোটর বাইকের আরোহী। তারাও ঘুমান যানজটে, চলতি পথে। ঘুমের সমস্যায় ভোগেন ৪ থেকে ৮০— সব বয়সের মানুষ। অনিদ্রায় ভুগছেন এমন মানুষ ১৮-২০ শতাংশ। নগরে এর পরিমাণ বেশি। চারদিকে আলোর ঝলকানি, শব্দের তাণ্ডবে ঘুমানোর পরিবেশই নেই। গত ১০ বছরে রাজধানীতে ঘুমের রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। এটা ডাক্তারদের আন্দাজ। গবেষণায় মিলতে পারে ভয়াবহ তথ্য। সেই গবেষণাটাই হচ্ছে না।  

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, যানজটে দীর্ঘ সময় বসে থাকায় মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি হয়, যা এক ধরনের ক্রনিক মেন্টাল হ্যাজার্ড। এতে তার মধ্যে বিরক্তি, বিষণ্নতা ও হতাশা দেখা যায়। হতাশা থেকে কিছু ক্ষেত্রে ক্রোধ তৈরি হয়। সেই ব্যক্তি তখন রাস্তাঘাটে ট্রাফিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। অপ্রয়োজনে হর্ন বাজান। তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। সর্বোপরি তার কাজের গতিও কমে যায়। স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, ঘুমের ঘাটতি হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বেড়ে যায় ডায়াবেটিস-হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা। ঘুমের সমস্যায় মহিলাদের ঋতুবন্ধ, বিষণ্নতা বাড়তে পারে। এ জন্য নির্বিঘ্ন ঘুমের পরিবেশ তৈরি করতে হবে নিজের চেষ্টায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর