মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডেঞ্জারজোন রাতের হাতিরঝিল

মানিক মুনতাসির

ডেঞ্জারজোন রাতের হাতিরঝিল

হাতিরঝিলে অবাধে চলছে ট্রাক কাভার্ডভ্যান

ঘটনা-১. গত ২৮ মার্চ রাত সোয়া ১০টা। হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজা কনকর্ড শপিংমলের সামনের রাস্তায় ট্রাকের চাপায় বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সোহেল (৪৫) মারা যান। সোহেল মোটরসাইকেলে গুলশান থেকে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরার দিকে যাচ্ছিলেন। পুলিশ প্লাজার মোড় পার হতেই পেছন থেকে হঠাৎ ট্রাকটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সোহেল।

ঘটনা-২. গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টা। হাতিরঝিলের রামপুরা অংশের ওভারব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমতিয়াজ আলী। হঠাৎ তিন যুবক তাকে ঘিরে ধরে। ছুরি দেখিয়ে ম্যানিবাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে তিনি রামপুরা থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি।

এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি গভীর রাতে হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় আবদুল্লাহ আল মামুন (৫০) নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মারা যান। ১১ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় মারা যান আবদুল মুত্তালিব খোকন নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী। ওই দিন আরও দুই মোটরসাইকেল আরোহী আহত হন। একই স্থানে রেস করতে গিয়ে ১৩ ডিসেম্বর রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি প্রাইভেট কার ঝিলের পানিতে পড়ে যায়।

ক্লান্তি কাটিয়ে প্রাকৃতিক বিনোদনের আশায় অনেকেই ছুটে যান হাতিরঝিলে। গ্রাম থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসা মানুষও হাতিরঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন। কিন্তু বিনোদনের এই ঝিল দিনে দিনে মৃত্যুকূপে রূপ নিয়েছে। মনোরম হাতিরঝিলে সন্ধ্যার পর পরই ঢুকে পড়ছে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন। এ ছাড়াও কারওয়ানবাজার থেকে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা পর্যন্ত চলছে অসংখ্য যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস। এসব মাইক্রোবাসের অধিকাংশই লক্কর ঝক্কর। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। যদিও হাতিরঝিলে এ ধরনের যান চলাচল নিষিদ্ধ। আর এসব ট্রাক আর কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় নিহত হচ্ছেন পথচারী। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এসব যানবাহন এমন একটি বিনোদনকেন্দ্রে ঢুকে পড়ছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার তথ্যমতে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। এখানে আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজনেরসহ কয়েকটি গাড়ি সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে লেকের পানিতে। কথিত বন্দুকযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫ জন।

তা ছাড়া প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে হাতিরঝিলে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা ও রমনা থানা নিয়ে গঠিত হাতিরঝিল এখন ‘ডেঞ্জারজোনে’ পরিণত হয়েছে। রাতের বেলায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। মোটরসাইকেল আরোহীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। আবার মোটরসাইকেল কিংবা বাস-ট্রাকের বেপরোয়া গতিও কেড়ে নিচ্ছে আরোহী কিংবা পথচারীর প্রাণ।

হাতিরঝিলে ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। ওভারপাস ও ফুটওভার ব্রিজগুলোতে সন্ধ্যার পর বসছে মাদকের আসর। ঝিলের ভিতর হকার প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও ঢুকে পড়ছে হকার। রাতে গতির নেশায় মেতে ওঠে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল চালকরা। আর ছুটির দিনে ঝিলের বিভিন্ন অংশে বাইসাইকেল আর মোটরসাইকেলের রেসও হচ্ছে। এ প্রকল্প এলাকাটি পাঁচটি থানার অধিভুক্ত হওয়ায় কোনো থানাই কোনো দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিতে চায় না। অপরাধী ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হয় না। এক থানা আরেক থানার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে অপরাধীদের ছেড়ে দেয়। হাতিরঝিলে ৭৭ জন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করছে। নানা অনিয়মের কারণে এ পর্যন্ত ২৩-২৪ জন নিরাপত্তাকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, শুধু হাতিরঝিল নয়, রাজধানীর যে কোনো স্থানে অপরাধ তত্পরতা বন্ধে পুলিশ তত্পর রয়েছে। অবৈধভাবে হাতিরঝিলে যেসব মাইক্রোবাস চলাচল করে সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া রাতের বেলায় যেন ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যান ঢুকতে না পারে সে জন্যও পুলিশ সদস্যরা টহল দিয়ে থাকেন।

সর্বশেষ খবর