মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভার্চুয়াল ভাইরাসে বিপদ ঘরে ঘরে

শিমুল মাহমুদ

ভার্চুয়াল ভাইরাসে বিপদ ঘরে ঘরে

রাজধানীর শাঁখারী বাজারের কলেজছাত্র রওনক হোসেন আগামী ২ এপ্রিলের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। গত বৃহস্পতিবার হোলি খেলার সময় খুন হয়ে যায় এই কিশোর। ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রেম এক কিশোরীর সঙ্গে। সেই কিশোরীর সম্পর্ক ছিল আরও একজনের সঙ্গে। সেই প্রেম থেকে বিরোধের জের ধরে রওনক খুন হয় বলে জানায় পুলিশ। ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রেম ও খুনোখুনির ঘটনা দেশে অসংখ্য।

দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে শুধু মোবাইলের মাধ্যমেই ২ কোটির বেশি ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার হয়। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণদের সংখ্যাই বেশি। কী করে তারা ইন্টারনেটে? ফেসবুক ব্যবহারের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে রাজধানী ঢাকার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। এই তথ্যে মনে হতে পারে আমরা খুবই সামাজিক হয়ে উঠছি। আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নামে ফেসবুক আমাদের চূড়ান্ত অসামাজিক, আত্মকেন্দ্রিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিন্দুক জাতিতে পরিণত করছে। অসংখ্য অপকর্মের বাহক হয়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটারসহ কথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। তরুণরা এখন ফেসবুকে প্রেম করছে। বয়স্করা পরকীয়া করছেন। প্রতারকরা মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। এমনকি আফ্রিকান, নাইজেরিয়ানরাও আমাদের বোকা বানিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতারণা করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফেসবুক পোস্টের কারণে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। এখন মনের কথা বলার, ক্ষোভ হতাশা নিন্দা জানানোর মাধ্যমই এই ফেসবুক। ফেসবুকে প্রেম করে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। প্রতারিত হয়ে জীবন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে কারও কারও। বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। শুধু লাইকের লোভে বিপজ্জনকভাবে সেলফি তুলছে আমাদের সেলফি প্রজন্ম। পরচর্চা ও প্রপাগান্ডার মোহে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে কাটিয়ে দিচ্ছে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ। হয়তো এই বাস্তবতা থেকেই জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ গেয়েছেন, ‘ফেসবুকে পেজ খুলে প্রেম করে যারা/ রেলগাড়ির চাক্কাতে হাওয়া দেয় তারা’।     

শুধু কি ফেসবুক, আছে অনলাইন গেম। সেলফি, ইউটিউব। অনেক বাবা-মা সন্তানকে স্মার্টফোন বা ট্যাব কিনে দিয়েছেন। কিন্তু সেই স্মার্টফোন বা ট্যাব হাতে পেয়ে সন্তানই যেন হাতছাড়া হয়ে গেছে। সারা দিন নেশাগ্রস্তের মতো বুঁদ হয়ে থাকে ডিজিটাল ডিভাইসে। এখন তাদের ক্ষুধা লাগে না। ঘুম আসে না। ক্লাসের রেজাল্ট ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। এই রাতজাগা তারুণ্যের সামনে কোনো স্বপ্ন নেই। বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। নেশাগ্রস্তের মতো আচ্ছন্ন থাকছে ডিজিটাল ডিভাইসে। ভার্চুয়াল জগতের এসব আগ্রাসী উপাদানগুলো আমাদের ভাইরাসের মতো ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেগুলোকেই এখন বলা হচ্ছে ‘ভার্চুয়াল ভাইরাস।’ ফেসবুক, স্মার্টফোন, সেলফি, ইউটিউব ও ভিডিও/অনলাইন গেমস ইত্যাদি ভার্চুয়াল ভাইরাসের আগ্রাসনে পুরো দেশ এমনকি বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। এসবের প্রভাবে সীমাহীন ক্ষতির মুখে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। প্রবীণ প্রজন্মও এর বাইরে নয়। ঘরে ঘরে এখন ডিজিটাল ডিভাইস আসক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নতুন করে কঠোর আইন করছে। অথচ ভার্চুয়াল ভাইরাসের আসক্তি মাদকের মতোই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভিতর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে পুরো সমাজকে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভার্চুয়াল ভাইরাস মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ; যার মর্মান্তিক পরিণতি শুধু ব্যক্তিকে নয়, ধ্বংস করে দিচ্ছে পরিবার, সমাজ এমনকি একটি জাতিকেও। গত কয়েক বছরে মার্কিন টিনএজারদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও স্মার্টফোনের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করছেন সে দেশের মনোবিজ্ঞানীরা।

গত বছরের ৭ জুন ইনডিপেন্ডেন্ট ইউকেতে প্রকাশিত তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যের হার্লি স্ট্রিট রিহ্যাব ক্লিনিকের একটি গবেষণায় বলা হয়, শিশুর হাতে স্মার্টফোন/ ট্যাব তুলে দেওয়া আর কোকেন বা মদের বোতল তুলে দেওয়া একই কথা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগের পরিচালক ড. পিটার  হোয়াইব্রোর মতে, স্মার্টফোন/ ট্যাব স্ক্রিন হলো ইলেকট্রনিক কোকেন। চীনা গবেষকরা একে বলছেন ডিজিটাল হেরোইন। আর পেন্টাগন ও ইউএস নেভির অ্যাডিকশন রিসার্চ বিভাগ ভিডিও গেম ও স্ক্রিন  টেকনোলজিকে অভিহিত করেছে ডিজিটাল মাদক হিসেবে।

এখন অনেক স্বামী বা স্ত্রী বুঝে ওঠার আগেই দেখেন, তার সঙ্গীটি ফেসবুকের কল্যাণে পরকীয়ায় লিপ্ত। সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। দাম্পত্য সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে অশান্তি ও অবিশ্বাস এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের সন্তানরা। ফেসবুক ব্যবহার করে প্রতারণা করার হার বাড়ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছেন অনেকে। ব্রিটেনেও প্রতি একশর মধ্যে ২০টি ডিভোর্সের ঘটনায় ভূমিকা রাখছে ফেসবুক। বাংলাদেশে কী হচ্ছে সেটা এখনো গবেষণার বাকি। ভার্চুয়াল ভাইরাসের কবল থেকে জাতিকে রক্ষায় দেশব্যাপী কাজ করছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।

যারা সুপরিকল্পিতভাবে এই ভার্চুয়াল ভাইরাস তৈরি করছেন তারা কিন্তু নিজেদের ও সন্তানদের বিষয়ে সচেতন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের উদ্ভাবিত স্মার্টফোন, আইপ্যাড ও কম্পিউটার গেমস পৌঁছে গেছে কোটি মানুষের ঘরে। অথচ তারা নিজেদের সন্তানদের ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেছেন শুরু থেকেই। বিল গেটস তার সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে মোবাইল ফোন কিনে দেননি। আর স্টিভ জবস তো নিজের উদ্ভাবিত আইপ্যাডই কখনো ব্যবহার করতে দেননি সন্তানদের। অথচ তাদের সেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত আমাদের লাখো সন্তান। তারা ফেসবুকে প্রেম করছে। পরস্পরকে গালাগাল করছে। পরীক্ষার প্রশ্ন পাচ্ছে। অন্যকে টিজ করছে। অনেকে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে ভালো কতটুকু হচ্ছে সেটা অবশ্যই পর্যালোচনার বিষয়। তাই ব্যবসায়িক কিংবা পেশাগত প্রয়োজন ছাড়া এসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর