মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরের নারী

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরের নারী

সকাল সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। ব্যস্ত শহরের বাসিন্দারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিছানা ছেড়ে কাজের জন্য বের হওয়ার। কিন্তু ব্যতিক্রম রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যান। ভোরের আলো ফুটতেই প্রাতঃভ্রমণ এবং ব্যায়ামের জন্য বের হন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। এর একটি বিশাল অংশ ৩৫-৫০ বয়সী নারী। তাদের হাঁটার কারণ জানতে চাইলে পাওয়া যায় স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস সমস্যার কথা। শহুরে জীবন আর আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কমে যাচ্ছে মানুষের কায়িক পরিশ্রমের পরিমাণ। পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসেও। এতে বেড়ে যাচ্ছে ওজন ও স্থূলতা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৯ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ২৯ শতাংশই অতি ওজন এবং ১২ শতাংশই স্থূলতায় ভুগছেন। বিভাগ পর্যায়ে নারীদের স্থূলতার হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে।

নারী-পুরুষভেদে মানুষের উচ্চতা ও ওজনের মানদণ্ড হলো বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)। বিএমআই দিয়ে সহজেই বোঝা যায়, একজন মানুষের কতটুকু ওজন থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বৈশ্বিক ভিত্তিতে একজন মানুষের বিএমআই ২৫ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এশিয়ার কাট অব ভ্যালুতে একজন মানুষের বিএমআই ২৩ কে স্বাভাবিক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কারও ক্ষেত্রে এটি ২৩ দশমিক ৫ হলে তাকে অতি ওজন, আর ২৫-এর উপরে গেলে স্থূল বলা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ বুলেটিন-২০১৭তে দেখা গেছে, এশিয়ান কাট অব ভ্যালু অনুযায়ী বিভাগ অনুসারে, স্থূল নারীর হার চট্টগ্রামে ১৮, ঢাকায় ১৭, খুলনায় ১৪, রাজশাহীতে ১২, বরিশালে ১১, রংপুরে ৮ ও সিলেটে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে অতি ওজনের নারীর হার খুলনায় ৩৫, চট্টগ্রামে ৩৪, বরিশালে ৩১, ঢাকায় ৩০, রাজশাহীতে ২৯, রংপুরে ২৩ ও সিলেটে ১৯ শতাংশ। দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ স্বাভাবিক ক্যাটাগরির, ৪১ শতাংশ অতি পুষ্টিসমৃদ্ধ, বিপরীতে অপুষ্টির শিকার নারীর সংখ্যা ১৬ শতাংশ, স্বল্প ওজনের ১৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে অতি ওজন ও স্থূলতার হার পর্যায়ক্রমে ৩৫ ও ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে এ হার যথাক্রমে ২৭ ও ৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অতি ওজন ও স্থূলতার মূল কারণ হলো ক্যালরি গ্রহণ ও তা ক্ষয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। এ ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম না করা, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া, খাদ্যাভ্যাস ও পরিশ্রমের ধরনের পরিবর্তন, পরিবহনের ধরনে পরিবর্তন, নগরায়ণের বিস্তার, কম ঘুমানো, মানসিক চাপসহ নানাবিধ কারণে মানুষের মধ্যে অতি ওজন ও স্থূলতা বাড়ছে। শারীরিক পরিশ্রম কম করা, অধিক মসলাযুক্ত ও তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার কারণে দেশের নারীদের মধ্যে অতি ওজন ও স্থূলতা বাড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এ্যাপোলো হসপিটালসের প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরী বলেন, সন্তান জন্মদানের পরবর্তী সময়ে নারীদের মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গর্ভকালীন পুষ্টি চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পায় নারীদের। এ কারণে স্বাভাবিক প্রসবের চাইতে বাড়ছে সিজারিয়ান অপারেশনের সংখ্যা। এর সঙ্গে শহুরে জীবনে অভ্যস্থতায় কম কায়িক পরিশ্রমে স্থূলতায় ভুগছেন নারীরা। সুস্থ থাকতে পরিমাণ মতো সময় মতো খাবার গ্রহণ এবং হাঁটার বিকল্প নেই।

নারীদের অতি ওজন ও স্থূলতা বৃদ্ধি নিয়ে ২০১৭ সালে একটি গবেষণা চালায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। ২০০৪-২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের প্রজননক্ষম নারীদের অতি ওজন ও স্থূলতা বৃদ্ধির মাত্রা পরিমাপ করেছে সংস্থাটি। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৪ সালে দেশে অতি ওজনের নারীর হার ছিল ১১ দশমিক ৪ শতাংশ আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ২ শতাংশে। এ ছাড়া দেশে নারীদের মধ্যে স্থূলতার হার ১০ বছরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, উচ্চশিক্ষিত, ধনী, চাকরি করে না ও শহরে বসবাসকারী নারীদের মধ্যে অতি ওজন ও স্থূলতার হার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর কমপক্ষে ২৮ লাখ মানুষ বাড়তি ওজন ও স্থূলতার কারণে মারা যান। নারীদের জন্য স্থূলতা নানাভাবে ক্ষতিকর। স্থূলতার কারণে নারীদের ডায়াবেটিস ও এন্ডমেট্রিয়াল ক্যান্সার, জরায়ুমুখ, স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, আয়েশি জীবনযাপন, ব্যায়াম বা হাঁটাচলার পরিমাণ কমে যাওয়ায় মুটিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। আগে মসলা পিষে রান্নার কাজ করা হতো, এখন সবই প্যাকেটে পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি ফাস্ট ফুড এবং কোমল পানীয় বেশি খাওয়াও স্থূলতার অন্যতম কারণ।

সর্বশেষ খবর