মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে হিজড়াদের জীবন

মাহবুব মমতাজী

বদলে যাচ্ছে হিজড়াদের জীবন

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরে স্থাপিত ‘মানবপল্লী’ নামে একটি কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এখন বসবাস করছে সমাজচ্যুত ‘হিজড়ারা’। সেখানে বদলে গেছে হিজড়াদের জীবনমান। কারিগরি শিক্ষা আর পশুপালনে নিজেরাই হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো আবারও স্বপ্ন দেখছেন।

সরকারি নানা প্রকল্প ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে অনেক হিজড়া আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। যা তাদের ‘হিজড়া’ পরিচয়ের বাইরে নতুন করে পরিচিতি দিয়েছে। সমাজে অবহেলার শিকার এই মানুষগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহীম। সফল এই উদ্যোগের জন্য তিনি সোশ্যাল ইনোভেটর ক্যাটাগরিতে আন্তর্জাতিক ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশনের ডব্লিউএলএফ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

পরে ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়।

২৪ বছর বয়সের একজন হিজড়া এ প্রতিবেদককে শোনান নিজের সেই দুঃখ-দুর্দশার দিন থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। ১৫ বছর আগে মাত্র নয় বছর বয়সে বাবা-মার নিষ্ঠুর আচরণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ওই দিন বাড়ির নিচতলায় চলছিল তার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান।

অথচ তাকে বাসার ছাদে বেঁধে রাখে বাবা-মা। দিনাজপুর জেলা স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল পাপ্পু। মানবপল্লীতে এখন সে সুন্দরী নামে পরিচিত। সবাই তার মনোজ্ঞ নাচের ভক্ত। নাচের অনুষ্ঠান করে এখন সে বেশ স্বাবলম্বী। ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও ধীরে ধীরে মেয়েলি স্বভাব ধারণ করে সে। এইচএসসি পর্যন্ত চলে তার পড়াশোনা।    

দিনাজপুরের বাংগিবেচা এলাকায় প্রায় ৮ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। এখানে পাকা মেঝে, টিনের ছাউনি আর ঘেরায় নির্মাণ করা হয়েছে ১২৫টি ঘর। এতে ৪০ জন হিজড়ার সঙ্গে থাকছে স্বাভাবিক মানুষও। এই মানবপল্লীতে মসজিদ-মন্দিরও স্থাপন করা হয়েছে।

এখানে রেখেই হিজড়াদের স্বনির্ভর করতে অনুদান হিসেবে জিআর, টিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। দুজনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় ও দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিবছর দিনাজপুর বড় মাঠে আয়োজন করা হয় বাণিজ্য মেলার।

সেখানে রয়েছে তাদের পার্টটাইম চাকরির সুযোগ। মাছ চাষের জন্য পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পেছনের পুকুরটিও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বছরজুড়েই দেওয়া হয় কাপড় সেলাই, গার্মেন্টসের কাজ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালনের প্রশিক্ষণ। সমাজসেবা ও সমবায় অধিদফতর থেকে ঋণের জন্য দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। এখান থেকে একেকজন ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করতে বিনা সুদে ১০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়েছে। পাশাপাশি পালনের জন্য তাদের দেওয়া হয়েছে ২৩টি গরু ও ২৩ ছাগল।

জেলা প্রশাসন জানায়, ২০১১ সালে দিনাজপুর শহরের অদূরে সরকারি জমিতে হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে মোট ৮০ জন হিজড়াকে আলাদা আলাদা ঘর দেওয়া হয়। সাথী হিজড়া উন্নয়ন সংঘ নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার হিজড়ারা এই মানবপল্লী তদারকি করে। সংঘের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ এ প্রতিবেদককে বলেন, মানবপল্লীতে পুনর্বাসনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। এই পল্লী হিজড়াদের পুনর্বাসনের জন্য একটি মডেল। 

সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা এখন প্রায় ১০ হাজার। তবে এনজিওগুলো বলছে- এ সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো।

সর্বশেষ খবর