শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শরম (এগার পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (এগার পর্ব)

অলঙ্করণ : আহমেদ তারেক

'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

 

কদিন ঘোরাঘুরি করে আইনক্সের শপার্স স্টপে সেলস গার্লের চাকরিটা পেল। কেউ বুঝলোই না জুলেখা এক বাচ্চার মা। ভাবলো বিয়েই বুঝি হয়নি। সুরঞ্জন পছন্দ করে না চাকরিটা। বলে-তোমাদের খাটিয়ে মারে। অথচ পয়সা দেয় না। এত কম পয়সায় কারও চলে! জুলেখা যা উপার্জন করে, বেশির ভাগই ঢেলে দেয় মামার সংসারে। দিতে হয়। হাতে সামান্য যা থাকে, তা দিয়ে বাচ্চার জন্য কিছু কেনা কাটা। আর সুরঞ্জনের কাছে যখন সে আসে, খালি হাতে। নিঃস্ব। সুরঞ্জন বলে,-এই ভালো। তোমারও কিছু নেই। আমারও নেই। আমাদের মধ্যে কেউ বড়, কেউ ছোট নয়। আমাদের মধ্যে তাই কোনও বৈষম্য নেই।

জুলেখার মামার বাড়িতে সুরঞ্জন পারতপক্ষে যায় না, যেতে চায় না। সে এখন এসে গেছে কাছে। জুলেখার জন্যই আসা। জুলেখাই যেন যখন খুশি চলে আসে জান নগরের বাড়িতে। সুরঞ্জন না থাকলেও কিরণময়ী আছেন।

মামার বাড়ির গল্প জুলেখা খুব একটা করে না। খুব যে ওখানে সুখে আছে সে তা সুরঞ্জন মনে করে না। তার সুখ একটাই, সোহাগ তার বাবাকে ফাঁকি দিয়ে জুলেখার সঙ্গে দেখা করতে আসে। জুলেখা সোহাগের জন্য চকলেট, বিস্কুট, জুতো জামা খেলনা কিনে রাখে। এলেই দেয় হাতে। জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। ইস্কুল কেমন চলছে, বাবা আদর করছে কি না, নতুন মা কেমন, দেখাশোনা করছে কি না এসব জিজ্ঞেস করে। সোহাগ সব কিছুতেই মাথা নাড়ে। এই ছোটবেলাতেই সোহাগকে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে যে সে তার নিজের মার সঙ্গে বাস করতে পারবে না। জুলেখার নিজের জন্য নয়, কষ্ট যদি হয় কারও জন্য, সে সোহাগের জন্য। সোহাগের জন্য টানটা নাড়ির টান। আর সারা দেহে-মনে যার সোহাগ চায় জুলেখা, সে সুরঞ্জনের। সুরঞ্জনকে ততদিন সফিকুল বলেই পাড়ার অতি কৌতুহলি পড়শিরা জানতো। এমনকী মামার বাড়িতেও বীরভূমের তুতো ভাই বলে চালিয়েছিল কদিন। কিন্তু ও বাড়িতে জুলেখার জন্য আলাদা কোনও ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়নি যে ওখানে তুতো ভাইকে নিয়ে একটু সময় একা থাকবে। মাটিতে বিছানা করে সে মামি আর মামাতো বোনরা যে ঘরে থাকে, সে ঘরে শোয়। ও বাড়িতে সুরঞ্জনকে ডাকলে মামার ঘরে বসিয়ে চা বিস্কুট খাইয়ে বিদায় দেওয়া ছাড়া গতি নেই। মামার মাংসের দোকান আছে ভবানীপুরে। অসচ্ছল নয় সংসার। কিন্তু খরচ করার তেমন অভ্যেস না থাকলে যা হয়, জীবন যাপনের মান খুব নিচুতে রয়ে যায়। জুলেখার বাপের বাড়িতে যে স্বচ্ছলতার ঢল নেমেছিল তা নয়, কিন্তু সে যে কোনও বিত্তেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। কলেজের ধনী মেয়েদের বাড়িতে সে গিয়েছে, থেকেছে। আড়ষ্টতা ধীরে ধীরে কেটে গেছে। শিক্ষক রবিউল ইসলামের ধর্ম আর কুসংস্কারহীন জীবন, তাঁর অত্যন্ত সভ্য আচার আচরণ, তাঁর রুচি সংস্কৃতি জুলেখাকে প্রভাবিত করেছে কলেজ জীবনের দীর্ঘ চারটি বছর। সুরঞ্জনকে তার মানুষ বলে মনে হয়। স্রেফ একটা হিন্দু ছেলে বলে মনে হয় না। আর বিশেষ করে সেদিন ওই ধর্ষণের ঘটনার দিন সুরঞ্জন কী করে যে বাধা দিতে চাইছিল, কী করে সে জুলেখাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মার খেলো, না, জুলেখার জীবনে এমন নাটকও কোনওদিন হয়নি, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেনি, যে কোনও ধর্ষক পুরুষের চোখে জল জমেছে তারই হাতের মুঠোয় তারই শিকারের জন্য মায়ায়। এই মায়া, এই চোখের জল, জুলেখার বিশ্বাস না মুসলিম না হিন্দু কোনও সম্প্রদায়ে পাবে না সে। এই সম্প্রদায় আলাদা সম্প্রদায়, তারা জাত ধর্মের অনেক ওপরে।

নিষ্ঠুরতা দেখে অভ্যস্ত জুলেখা। ছ বছর ধরে মহব্বতের কঠোর কঠিন মুখ দেখছে সে। কোনওদিন দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে যায়নি। গেছে যদি সে কোনও আত্দীয়ের বাড়িতে হঠাৎ কোনও প্রয়োজনে। নয়তো জঙ্গিপুরে। বাড়িতে কোনও বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, কোনও আত্দীয়স্বজনের ভিড় কিছু হয়নি। মহব্বতের ইচ্ছে কলকাতায় খেটে ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে এক সময় জঙ্গিপুরে চলে যাবে। পুরোনো কাঠের ব্যবসায় নামবে নয়তো আসবাবপত্রের দোকান দেবে। বরং ভালোবাসারই কাঙাল ছিল সে।

সে সন্ধেয় জুলেখার সাতাশ বছরের আগুনকে সুরঞ্জন তার সাইত্রিশ বছরের জলে নিভিয়ে বলে,-কে এসেছিল জানো তো?

-কে?

-ওই ভদ্রমহিলাকে চেনো না?

-না তো।

-নিশ্চয়ই চেনো।

-উহু! জুলেখা মাথা নাড়ে। সে মনে করতে পারছে না।

-তসলিমা নাসরিন।

সুরঞ্জন একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথাটা খাটের রেলিংএ রেখে বলে। জুলেখা সুরঞ্জনের হাতের সিগারেটের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। তার সহ্য হয় না সিগারেটের গন্ধ।

-পড়োনি তার বই?

-অনেক আগে পড়েছিলাম। ইস্কুলে থাকাকালীন। নির্বাচিত কলাম।

-লজ্জা পড়োনি?

-নাহ।

-বল কি?

-কেন?

-লজ্জা তো প্রায় সবাই পড়েছে বোধহয়। তুমি ছাড়া।

জুলেখা জোরে হেসে ওঠে।

-তো ওই লেখিকা তোমার বাড়িতে কেন?

-দেশেই চেনা ছিল।

-দেশতুতো?

-হ্যাঁ। জুলেখার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে, তুমি যেমন পাড়াতুতো।

-হুম।

জুলেখা কখনও বলে না যে মামার বাড়িতে থাকার বদলে সুরঞ্জনের বাড়ি এসে থাকতে সে পারে। সুরঞ্জনও বলে না জুলেখাকে একসঙ্গে বাস করার কথা। ভেতরে প্রত্যাশা ছিল অনেকদিন। সে ভেবেছে, সুরঞ্জন নিজেই একদিন বলবে যে এত জ্বালা কী করে সইছো, এ বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়ি চলে এসো, চলো দুজন একবাড়িতে একসঙ্গে থাকি। মনে যদি মেলে শরীরে যদি মেলে, তবে দুজন একসঙ্গে না থেকে আলাদা থাকার কী অর্থ জুলেখা জানে না। কোথায় সুরঞ্জনের অসুবিধে! জুলেখা জিজ্ঞেসও করে না অসুবিধেটি কোথায়। জুলেখা একটা জিনিস এখন আর করে না, সে হল প্রত্যাশা। প্রত্যাশা না থাকলে যা কিছুই সে পেয়ে যায়, প্রচণ্ড ভালো লাগা থাকে তাতে। সুরঞ্জন যেদিন বলবে চলে এসো, সেদিন সে চলে আসবে, এক মুহূর্ত দেরি করবে না।

সুরঞ্জন কেন বলছে না জুলেখাকে চলে আসতে! সুরঞ্জন কি নিজে জানে! বেলঘরিয়া ছেড়ে এসে এই পার্ক সার্কাসে সে কি থাকছে শুধু প্রেম করার জন্য! ভেতরে কোনও স্বপ্ন নেই? ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে তার। জুলেখার জন্য তার মায়া হয়, করুণা হয়, ভালোওবাসে মেয়েটাকে। কী নিরীহ নিষ্পাপ কী সৎ আর শক্ত মেয়েটি। সুদেষ্ণা যদি এমন হত! সুদেষ্ণার সঙ্গে তো প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল। জুলেখার প্রতি মূলত একটা অপরাধবোধ কাজ করেছে তার। ভয়াবহ একটা অপরাধবোধ। সেই অপরাধবোধ থেকে করুণা। করুণা থেকে কী রকম একটা মায়া পড়ে যাওয়া। মায়ার জন্য যেমন একটা মায়া সুরঞ্জনের সবসময় আছে, সেরকম। জুলেখার সঙ্গে শরীর বিনিময় করে সে। না, কেবল শরীরের জন্যই নয়। মন থাকে ওতে। কিন্তু জুলেখাকে হঠাৎ বিয়ে করে ঘরে তোলা, ওই এক চিলতে ঘরে, এ ঠিক সুরঞ্জন ভেতর থেকে মেনে নিতে পারে না। পাড়ায় তার মুসলমান বন্ধুদের একটা দল আছে, দলটা ভারি হচ্ছে, সেখানে জুলেখাকে বিয়ে করতে চাইলে ঠিক কী অবস্থায় পড়তে হবে, সুরঞ্জন জানে না, তার ভয় হয়। হ্যাঁ সুরঞ্জনের ভয় হয়। তার আগের সেই সাহস, সে লক্ষ করে, নেই আর। সাহসের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার ভেতরে, তা ওই সেদিনই সে দেখিয়েছে। অচিন্ত্যদের হাত থেকে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছে। অবশ্য বাঁচানোই বা কি একে বলে! চার চারটে পুরুষ তো ধর্ষণ করেইছে, ওদের তো বাধা সুরঞ্জন দেয়নি। প্রথম থেকে তো বাধা সে দিতে চেষ্টা করেনি। বরং প্রথম ধর্ষণটা সে নিজেই করবে বলে আশা করেছিল। জুলেখার পরিণতির জন্য সুরঞ্জন একশ ভাগ দায়ী। অপহরণ। তালাক। মামার বাড়ির মেঝের জীবন। দিন রাত্তির উপেক্ষা আর অবজ্ঞার জীবন। মহব্বতের বাড়িতে অন্তত একটা অধিকার ছিল, স্ত্রীর অধিকার। স্বামীর অধিকারের তুলনায় তা অনেক কম যদিও। আর সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা যেটা ছিল, সেটা সোহাগ। সোহাগকে তার পাওয়া হত। সুরঞ্জনের কারণে ধর্ষিতা হওয়া আর তালাক পাওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি জুলেখার হয়েছে, সে হল সোহাগকে হারানো।

সুরঞ্জন হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে জামা কাপড় পরতে পরতে জুলেখাকে বলে,-তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও।

-কোথায় যাবে?

-তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাবো এক বন্ধুর বাড়িতে। খুব দরকার

-কোন বন্ধু?

-তুমি চিনবে না।

-নাম বল, দেখি চিনি কি না।

-তুমি তো বলেছিলে আজ আর কারও বাড়িতে যাবে না।

-যাবে না বলেছিলাম, কিন্তু যেতে হবেই।

-কার বাড়িতে? আমজাদের?

সুরঞ্জন কথা বলে না। জুলেখার মুখখানা খুব বিষণ্ন দেখায়। তার ধারণা সুরঞ্জন কোনও বন্ধুর বাড়ি যাবে না। অন্য কোথাও যাবে।

৫.

সুরঞ্জনের জীবন রহস্যময়। কিরণময়ীর নয়। সাধারণত রহস্য বোধহয় পুরুষেরই বেশি, নারীর জীবন আরেক নারী বেশ পড়ে নিতে পারে। আমার জীবনভর তাই হয়েছে, পুরুষ চেনা আমার কোনওদিন সম্ভব হয়নি। সুরঞ্জনকে যত আমি জানতে চাই, তত ধাককা খেয়ে ফেরত আসি।

কিরণময়ী যত্ন করে আমাকে খাইয়েছেন। চোখের জল ফেলেছেন। কীরকম মায়ের মত মা মা ডেকে কথা বলেছেন। মা হওয়ার সাধ্য তো কারওর নেই। কিন্তু ওই যে মা ডাকটা, তাই বা কজন ডাকে। ওই ডাকটির জন্য, এবং যেহেতু সুধাময়ের মৃত্যুর পর অভাব এসে বসেছে ঘরে, তাই তরুণকে দিয়ে একটি খাম পাঠাই কিরুণময়ীকে উপহার হিসেবে দিয়ে আসার জন্য, খামের ভেতর দশ হাজার টাকা। তরুণ দিয়ে আসে। সেই খামটি সুরঞ্জন রাত এগারোটায় আমার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসে। দরজা খুললেই সে আমার হাতের দিকে খামটি এগিয়ে দিয়ে বলে,-এটা আপনি ভুল করে পাঠিয়েছিলেন।

তাকে ডাকি ভেতরে আসার জন্য। ভেতরে সে ঢোকে এক মুখ মদের গন্ধ নিয়ে। খামটি হাতে দিয়ে বলে, -নিজেকে ছোট করবেন না।

আমার কণ্ঠে বিরক্তি।

-নিজেকে ছোট? নিজেকে ছোট আবার কী করে করলাম।

একটা গিফট দিতে পারি না?

-না এত টাকা আপনি গিফট দিতে পারেন না। আমাদের চলছে সংসার। আপনার সংসারের মতো এত ভালোভাবে না চললেও চলছে। আমরা বানের জলে ভেসে যাচ্ছি না। মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে।

তা ঠিক। সুরঞ্জনরা যেভাবে বেঁচে আছে, ভারতবর্ষে লক্ষ পরিবার এভাবেই বেঁচে থাকে। শুধু তাই নয়, এর চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় মানুষ থাকছে। টাকাটা ফেরত দেওয়ার অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, এসবের কাঙাল তারা নয়। গোপনে একটি শ্রদ্ধা জাগে কিরণময়ী এবং সুরঞ্জনের জন্য। টাকাটা নিলে যে অশ্রদ্ধা জাগতো তা নয়, নিলে মনে হতে পারতো আমাকে আপন ভেবেই নিয়েছে, কখনও যদি অবস্থার পরিবর্তন হয়, হয়তো শোধ দিয়ে দেবে। আমি ফেরত চাই না টাকা। কী জানি, কাউকে ঋণী করে রাখতে বোধহয় ভালো লাগে। আমি দেখেছি, কারও কাছে কিছুর জন্য ঋণী হলে আমার অসম্ভব অস্বস্তি হয়, যতক্ষণ না তাকে ঋণী করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই। [চলবে]

সর্বশেষ খবর