বোধহয় আমার মাথা উঁচু করে চলার পক্ষে অন্যকে আমার কাছে ঋণী করে রাখা এবং নিজে কারও কাছে ঋণী না হওয়াটা একটা কৌশল। অবচেতন মনে এই কৌশল কি আমি খাটিয়ে যাচ্ছি! হয়তো। অথবা হয়তো নয়। নিজেকে আমি চাক চাক করে ধারালো ছুরিতে কাটি। আবার নিজের ওপরই মায়া করে ছুরিটা সরিয়ে নিই। ছুরি সরিয়ে নিয়েই সুরঞ্জনকে বললাম-
-বোসো।
-না। সুরঞ্জনের উত্তর।-আরে বোসোই না কিছুক্ষণ।
অগত্যা সে বসে।
-শুধু মদই নাকি খাবারই কিছু খেয়েছো?
-খাইনি।
-খেয়ে যাও।
-না।
-কেন?
-বাড়ি গিয়ে খাবো।
-এত রাতে তোমার মাকে উঠে তো ভাত দিতে হবে।
-প্রতিরাতেই তো হয়।
-চমৎকার কাজটা করো। একজন বয়স্ক মানুষকে খাটিয়ে মেরে।
-এ করে তিনি যদি আনন্দ পান!
-আনন্দের বেশি কিছু না থাকলে অবশ্য এসবেই আনন্দ পায় মানুষ। এখানে খেয়ে যাও।
-মার কথা বলছেন কেন। নিজেও কি কম যান নাকি! আমাকে খাইয়ে মনে হচ্ছে আপনি প্রভূত আনন্দ লাভ করবেন।
আমি জোরে হেসে উঠি। সুরঞ্জনও হাসে। হাসতে হাসতে বলে,-
-ভাত খাবো না, হুইস্কি থাকলে খেতে পারি।
আমি নিজে হুইস্কি খাই না। বন্ধুদের কেউ কেউ খায় বলে রাখতে হয়। ব্ল্যাক লেবেলের একটা বোতল সুরঞ্জনের হাতে দিয়ে বলি,
-নিজে ঢেলে নাও।
সুজাতা গ্লাস জল সব দিয়ে যায়। সুরঞ্জন বলে,-এর চেয়ে কম দামি কিছু নেই? এসব খেয়ে আমি অভ্যস্ত নই।
-ভালো জিনিস খেতে ইচ্ছে করে না? অত বিপ্লবীর ভান করো না, বুঝলে। খারাপ জিনিস খাবো, খারাপ পোশাক পরবো, বস্তিতে থাকবো, চাকরি করবো না, প্রতিষ্ঠানবিরোধী হব, অ্যানার্কিস্ট হব, তাহলেই বেশ একটা আদর্শবাদী বিপ্লবী হয়ে যাওয়া যায়! অত সহজ!
-খারাপ জিনিস খাওয়া, খারাপ জায়গায় থাকা আপনি যত সহজ ভাবছেন, তত সহজ নয় কিন্তু। এই গরমে ফ্যান ছাড়া এসি ছাড়া থাকতে পারবেন, হাজার হাজার মানুষ যেভাবে থাকছে!
খেতে পারবেন দুবেলা শুধু শাকভাত!
-শাক আমি খুব পছন্দ করি। শাক কে বলেছে খারাপ খাবার।
-মাছ মাংস খান বলে শাক ভালো লাগে। নিউট্রিশন ভিটামিন আছে বলে এসব তো এখন বড়লোকের খাবার। ছোট মাছের দিকে ঝুঁকে ছোট মাছের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা, খাবারের মধ্যে কী পছন্দ করেন না, বলুন তো?
-মানে?
-মানে কোন খাবারটা পছন্দ করেন না?
-করল্লা।
-খেতে পারবেন এভরিডে করল্লা দিয়ে ভাত!
-শোনো আমি ভালো খাবার খাই, ভালো জায়গায় থাকি বলে কিন্তু এটা মানে নয় যে যারা খেতে পায় না, অথবা স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং যাদের লো, তাদের আমি অপমান করছি। আমি চাই সবার স্ট্যান্ডার্ডটা বাড়ুক। সবাই স্বচ্ছল হোক।
-সে তো চমৎকার আরামে-আয়েশে থেকে বলাই যায়। বলার মতো সহজ কিছু নেই। সবাই যদি আপনার মতো অবস্থায় চলে আসে, আপনার ভালো লাগবে না। কারণ আরামটা আপনার হবে না। আপনার ঘরের কাজ করার জন্য দাসি পাবেন না। আপনার গাছে জল দেওয়ার মালি পাবেন না। গাড়ি চালানোর ড্রাইভার পাবেন না।
-পেলেই তো অভ্যেস খারাপ হয়। না পাওয়ার ব্যবস্থা করো। এসব তো তোমার কম্যুনিজমের কথা। তুমি তো এসবে বিশ্বাস করতে। এদেশের কমুনিস্ট দলে নাম লেখাওনি?
-নাহ।
-কেন?
-কম্যুনিজম পৃথিবীর কোথাও নেই। এরা পুঁজিবাদীর চেয়েও বড় পুঁজিবাদী।
-এভুলুশন তো সব কিছুরই আছে।
সুরঞ্জন হেসে বলে,-এটা তো একটা এঙ্কিউজ। যুগের সাথে তাল মেলানোর নাম করে বড়লোকের স্বার্থ দেখা।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে পরিবেশ। হঠাৎ প্রশ্ন করি,-সুরঞ্জন, তুমি কি প্রায়শ্চিত্য করছো?
-না।
-তবে কী করছো?
-প্রায়শ্চিত্য করছি না।
-জুলেখার সঙ্গে কী করছো তুমি?
সুরঞ্জন চুপ।
-ওকে তো ভালোবাসো না। ভালো তো ওকে তুমি বাসো না।
শুধু শুধু মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করছো কেন?
-বাসি না কে বললো?
-বাসো না।
সুরঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো আমার দিকে।-
বাসি না কে বললো?
-জুলেখাকে তুমি ভালোবাসো, সুরঞ্জন? আমি জোরে হেসে উঠি।
সুরঞ্জনের কপালে অনেকগুলো ভাঁজ।
-একটা মুসলমান মেয়েকে তুমি ভালোবাসো?
-বাসি।
-বিশ্বাস হচ্ছে না।
-বিশ্বাস কেন হচ্ছে না?
-কারণ ...
-কারণ তুমি তো মুসলমানদের ঘৃণা করো। এই তো!
-হ্যাঁ।
-জীবনটা এত ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নয়, তসলিমা।
কখনও আমাকে তসলিমা বলে সম্বোধন করেনি সুরঞ্জন। এই প্রথম। আগে তো তসলিমাদি বলে ডাকতো।
-তসলিমা, আপনি হঠাৎ মুসলমানের প্রতি এত দরদি হয়ে উঠলেন কেন? কোনওদিন তো দরদি ছিলেন না। লজ্জার পাতা ভরে বর্ণনা করেছেন হিন্দুর ওপর মুসলমানের অত্যাচার।
-যা সত্য তাই বলেছি।
-হ্যাঁ বলেছেন। এখানকার সত্য চোখে দেখেন না কেন? নাকি দেখেও দেখতে চান না।
-কী বোঝাতে চাইছো?
-যা বোঝাতে চাইছি, তা খুব ভালো বুঝতে পারছেন।
-না। আরও একটু বুঝিয়ে বল। তুমি কি বলতে চাইছো এখানকার সত্য হল বাংলাদেশের উল্টো? মুসলমানের ওপর হিন্দুর অত্যাচার? নাহ, আমি এরকম কিছু নিজের চোখে দেখিনি। মুসলমানের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করে না বলে এখানকার হিন্দুরা মুসলমান এবং ইসলাম সম্পর্কে ততটা জানে না। হ্যাঁ গুজরাটে মুসলমানের ওপর অত্যাচার হয়েছে। হিন্দুরাই তো প্রতিবাদ করেছে সবচেয়ে বেশি। আমিও করেছি।
-সে তো না করলে ইন্টেলেকচুয়াল হওয়া যায় না বলে করেছেন।
-বাজে কথা বলো না সুরঞ্জন। কেউ হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক, আমার কাছে সে মানুষ। মানুষ, এই পরিচয়টিই আমি মানি। অন্য পরিচয় না। মানুষের মধ্যে মন্দ ভালো থাকে। কেউ রক্ষণশীল, কেউ নয়। কেউ মৌলবাদী মন মানসিকতার, কেউ সেকুলার। কেউ ...
আমার কথা শেষ হতে দেয় না সুরঞ্জন। বলে,-বাড়ি থেকে একটু বেরিয়েছেন ওই সব বস্তির দিকে। কীভাবে জীবন যাপন করে ওরা?
-কারা?
-মুসলমানরা।
-বস্তিতে হিন্দুরা নেই? দারিদ্র ভোগ হিন্দুরা করছে না? কেউ ধনী কেউ দরিদ্র, ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এগুলো রাজনৈতিক চক্রান্ত। হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয়। মুসলমানরা ধনী হয় না? ভারতবর্ষে কত ধনী মুসলমান আছে, জানো? বলতে পারো, মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে আছে। এখন তারা যদি ধর্মকে আইন বানিয়ে বসে থাকে, মাদ্রাসা বানিয়ে ওতে পড়তে যায়, যদি সত্যিকার বিজ্ঞান শিক্ষাটা না নেয়, মেয়েদের বোরখার মধ্যে পুরে রাখে, স্বনির্ভর হতে বাধা দেয়, তবে সমাজটার উন্নতি কী করে হবে বলো? অর্থনৈতিক, মানসিক কিছুরই উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। আমি তো একটা দলও করেছি, ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চ। এই মঞ্চে মুসলমান পরিবারে জন্ম, কিন্তু নাস্তিক, তাদের জড়ো করা হয়েছে ধর্মীয় আইনের বিলুপ্তি করে সমানাধিকারের ভিত্তিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ধর্মমুক্ত সমাজ, ধর্মমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, মানবাধিকার, নারীর অধিকার এসব বিষয়ে লড়াই করার জন্য। পিছিয়ে থাকা মানুষের প্রতি যদি সত্যিই সহানুভূতি থাকে, তবে এগুলো করা উচিত। দারিদ্র দেখে চোখের জল ফেলে ওদের জন্য সত্যিকার কিছু করা হয় না।
ফালতু।
সুরঞ্জন দেখি মন দিয়ে শুনছে যা বলছি। একটি সিগারেটও ধরিয়েছে। আমার ফ্ল্যাটে সিগারেট খাওয়া বারণ, সুতরাং খেলে বারান্দায় যাও, ওখানে ব্যাঙের মুখ আছে ছাইদানি, ওতে ছাই ফেলো। এরকম বলে দিই।
বারান্দা ভাসছে হাসনুহানা ফুলের ঘ্রাণে। সুরঞ্জন হুইস্কি খেয়ে যাচ্ছে। আমি না হুইস্কি, না সিগারেট। সিগারেটের কবল থেকে বেরিয়েছি বলে মুক্তির স্বাদ পাই।
-আচ্ছা, সুরঞ্জন, তুমি না একটা হিন্দু মৌলবাদী ছিলে?
-ছিলাম। ভীষণভাবে ছিলাম। তাই থাকতে চেয়েছিলাম।
-তারপর কী হল?
-জানি না কী হল।
-নিশ্চয়ই জানো। কেউ কি জানে না তার ভেতরে কী হয়?
-হ্যাঁ এরকম হতে পারে যে জানে না।
-তুমি কি মৌলবাদী নও?
-জানি না।
-বাজে কথা বলো না। হ্যাঁ কী না, ঠিক করে বলো।
-আমি তো বলছিই, যে, জানি না।
-না, এরকম হতে পারে না। মানুষ আর কারও সম্পর্কে না জানুক, নিজের সম্পর্কে জানে।
-আমি তো জানি না।
-তুমি কনফিউজড?
-হয়তো।
-কলকাতায় এত এলাকা থাকতে তোমার পার্ক সার্কাসে থাকার কী কারণ, বলো তো।
সুরঞ্জন ওই আলো অাঁধার বারান্দায় আমার চোখে স্থির চোখ রেখে বললো, -জুলেখা।
-জুলেখা?
-হ্যাঁ জুলেখা।
সুরঞ্জন তার হাতের সিগারেটটা শেষ হলে চলে যায়। আমাকে ওখানেই স্তম্ভিত করে রেখে সে দরজা খুলে বেরোয়। আমি অনেকক্ষণ বসে থাকি, যেখানে বসেছিলাম। সামনে খাম, খামের ভেতর ফিরিয়ে দেওয়া দশ হাজার টাকা। আমার কেমন যেন একা লাগে। [ চলবে ]