শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শরম (১৫তম পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (১৫তম পর্ব)

অলঙ্করণ: তারেক

কথাটা তীক্ষ্ন। জুলেখা জানে না কথাটা বেঁধে কিনা সুরঞ্জনের বুকে। তার মনে হয় না আদৌ বেঁধে। সিউড়ি সম্পর্কে আর কোনও কিছু সুরঞ্জন জানতে চায় না। জুলেখারও আগ বাড়িয়ে বলার কিছু ছিল না। তার দিদি আর গুরুজনদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছে, তা আর সবাইকেই সে বলতে পারে, কিন্তু সুরঞ্জনকে সে পারে না। তাকে সে যদি নিজ মুখে বলে যে আমাকে আসলে দূর দূর করে তাড়িয়েছে ওরা, সুরঞ্জনের মনে হতে পারে, এখন তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তার সাহায্য চাইছে সে। জুলেখা বরং এমন ভাব দেখায় যে কিছুই হয়নি মন্দ। যেন জুলেখা যা করছে, তাতে সবারই মত আছে, সমর্থন আছে। আত্দীয় বন্ধু সবাই আশ্বাস দিয়েছে সহযোগিতা করার। তার মতো করে জীবন তাকে যাপন করতে বলা হয়েছে। সবারই শুভ কামনা, তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে, তার জন্য ছিল এবং আছে। পরিবার থেকে, গোত্র থেকে, সম্প্রদায় থেকে, সমাজ থেকে সকলেই জুলেখাকে বাহবা দিচ্ছে।

কেন বলবে সে সুরঞ্জনকে সব কথা? আত্দসম্মান বলে কিছু তো এখনও তার অবশিষ্ট আছে। সত্যিকার আত্দসম্মান নিয়ে বেঁচে সে থাকতে চায়। কোথাও কোনও কাজ সে করতে চায়। কোনও ইস্কুলে সে মাস্টারির চাকরি যদি পেতে পারতো। সুরঞ্জনের তো জানা শোনা আছে কলকাতা শহরে। নিজেও সুরঞ্জন অনেকদিন শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছে। যদি সে ইচ্ছে করতো, হয়তো পারতো, জুলেখাকে এই সাহায্যটুকু করার। জুলেখা কারও কাছে কিছু প্রত্যাশা করে না, করতে চায় না, তারপরও মনের গভীর কোনও কোণে লুকিয়ে থাকে কিছু প্রত্যাশা। যেমন খুব গোপনে সুরঞ্জনের কাছে ছিল, ছিল তার বড় বোনটির কাছে যে সুলেখা হয়তো ফেরাবে না, হয়তো রবিউল আর সুলতানার কাছে ছিল। ভরসা করার জন্য জুলেখার তো আর কয়েকশ লোক ছিল না, হাতেগোনা কজন মাত্র। প্রত্যাশার সঙ্গে আবার সে একা একা লড়তে থাকে। একে সে জীবন থেকে পুরোপুরি ছুট্টি দিয়ে দিতে পারলে সত্যিকার মুক্তি পাবে।

যাদের কেউ নেই কিছু নেই যাদের কোনও স্বপ্ন নেই, তারা কি এই শহরে বেঁচে নেই! যারা শুধু বেঁচে আছে বলে নিঃশ্বাস নেয়, যারা শূন্য চোখে শূন্য বুকে বসে থাকে অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে! তাদের মতোও তো হতে পারে জুলেখা!

মামাবাড়ির তেল চিটচিটে বালিশ আর পেচ্ছাবের গন্ধে ভরা বিছানার চাদরটি গায়ে জড়িয়ে জুলেখাকে শুতে হয়, তাও আবার পেচ্ছাবপায়খানার হাঁ হয়ে থাকা দরজার দিকে মুখ করে। সুরঞ্জন যদি দেখতো কোথায় ঘুমোয় জুলেখা, কীভাবে এই বাড়িতে সে থাকে, কীভাবে প্রতিদিন! জুলেখার সন্দেহ হয়, তার দুর্ভোগ দেখে সুরঞ্জনের কোনও মমতার উদ্রেক আদৌ হবে কি না, হয়তো চুক চুক করে কিছু দুঃখ করবে, এর বেশি কিছু নয়। জুলেখা নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে ওরই বা কী ক্ষমতা। ও নিজেই তো দুরবস্থার মধ্যে আছে। ওর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড তো কবেই ভেঙে বসে আছে। দৃশ্য দেখলে বরং সুরঞ্জনের ওপর চাপ বাড়বে। তারচেয়ে ও যদি না দেখে, তাহলে জুলেখার মনে হবে, দেখলে হয়তো সে এখান থেকে জুলেখাকে বের করে নিয়ে যেত। আর দেখলে যদি বের করে নিয়ে না যায়! এই ভয়ে জুলেখা চায় না সুরঞ্জন দেখুক কিছু। কারণ সে যে করেই হোক চায় পরস্পরের প্রতি তাদের উত্তাপ এবং আকর্ষণটা থাকুক, বেঁচে থাকুক। এটা জুলেখার কাছে এখন সব দুঃখ মোচনের জায়গা হয়ে গেছে। সুরঞ্জন না থাকলে, জুলেখার জগত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। অন্তত একটি লোক জুলেখা পেয়েছে, যে শরীরের সম্পর্কে গিয়েছে, কিন্তু তাকে কোনওদিনই ধর্ষণ করেনি। জুলেখা না চাইলে সুরঞ্জন তাকে কোনওদিন স্পর্শও করে না। সুরঞ্জন ধীরে ধীরে তার নিজের অজান্তেই জুলেখার জীবনের একমাত্র সুখ হয়ে উঠেছে। ওকে কোনওরকম দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধের ধারে কাছেও জুলেখা যেতে দিতে চায় না। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হলে মুক্তির দরকার, বন্ধন নয়। আসলে, সম্পর্ক যদি মুক্তি না দেয়, বন্ধন দেয়, তবে সম্পর্কে আনন্দ রইলো কই! সম্পর্ক যদি জগদ্দল পাথরের মতো হয়, তবে সেই সম্পর্ক কোনও স্বস্তি দেবে না।

সুরঞ্জনের থাকুক না জানা সব। সুরঞ্জন জানুক, যে, মামাবাড়িতে, খুব একটা কিছু অসুবিধে হচ্ছে না, জানুক যে, চাকরিটাও বেশ চলছে, শপার্স স্টপে মাইনে তার পাঁচ হাজার, বছর বছর মাইনে বাড়বে, জানুক যে সোহাগ দিনরাত মায়ের জন্য কাঁদছে। কিছু ভালো জিনিস জুলেখাকে নিয়ে জানুক সে। এটুকুও যদি না জানে সে তবে তো জুলেখা তার কাছে গণধর্ষণের শিকার, স্বামীর মার খাওয়া, তালাক পাওয়া অসহায় নারী ছাড়া আর কিছু নয়। এবং দ্বিতীয়বার সে চায় না তার জন্য সুরঞ্জনের করুণার উদ্রেক হোক। করুণার জায়গায় ভালোবাসা ঢুকেছে, আবার সে চায় না ভালোবাসার জায়গায় করুণা ঢুকে গিয়ে সর্বনাশ করুক তার।

মাঝে মাঝে অবশ্য এ নিয়ে সংশয় হয় জুলেখার, আসলেই কি সুরঞ্জনের মনে তার জন্য কোনও ভালোবাসা আছে? নাকি তাকে বিনা পয়সায় বিনা দায়িত্বে ভোগ করার একটা চমৎকার সুযোগ সে পেয়ে গেছে মাত্র, আর কিছু নয়! এ শহরের কোনও মেয়ের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক হতে পারতো না। যে কোনও মেয়েই দাবি করতো অনেক কিছু, অথবা বলতো বিয়ে কর। আর তা যদি না হয়, তবে তো সোনাগাছি আছে। ওখানেও ঝুঁকি আছে, পয়সা খরচা আছে। জুলেখা সুরঞ্জনের অর্থনৈতিক সামাজিক পারিবারিক অবস্থায় কোনও অসুবিধে সৃষ্টি করছে না। বরং দিচ্ছে কেবল অকাতরে তাকে। হৃদয় এবং শরীর এই দুটোই নিঃশর্তভাবে দিচ্ছে। মানুষ কি কেবল দিয়েই যেতে পারে ক্রমাগত! জুলেখার খুব একা লাগে।

একা লাগাটার প্রয়োজন আছে খুব। চোখ ফেটে যখন জল চলে আসতে চায় জুলেখা আটকে রাখে। তার চোখের জল ফেললে চলবে না। প্রতিদিন কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে ওতে চাকরির সুযোগের দিকে ঝুঁকে থাকে। যে চাকরিটি সে করছে, অনুভব করে, ইউনিফর্ম পরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার কাজের চেয়ে আরও ভালো কাজ করার যোগ্যতা তার আছে। যদি পেয়ে যায়, সে চলে যাবে এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও। সোহাগ ভালো আছে। সে যদি মাকে ভালোবাসে, মাকে খুঁজে নেবে সে। সুরঞ্জনও যাবে, যদি ভালোবাসে। পার্ক সার্কাসে সুরঞ্জনের থাকা, বেলঘরিয়ায় এতদিনের বাস ছেড়ে চলে আসা, জুলেখার মনে হয় না, যতই সুরঞ্জন দাবি করুক যে তার জন্য, আসলে তার জন্য। এর পেছনে অন্য কোনও কারণ নিশ্চয়ই সুরঞ্জনের আছে।

৭.জুলেখার সঙ্গে সুরঞ্জনের সম্পর্কের কথা জানার পর ভীষণ রকম ক্ষিপ্ত মায়া। সুরঞ্জনকে সে বলে দিয়েছে, ওই সম্পর্ক থাকলে আমার সঙ্গে তোর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। যে কোনও একটা তোর বেছে নিতে হবে দাদা।

মায়ার এই দাদা ডাকটি সে কখনও শুনবে না, এ সুরঞ্জন কল্পনাও করতে পারবে না। পৃথিবী ভেসে যাক, মায়ার জন্য সর্বস্ব সে বিসর্জন দেবে। কিরণময়ীও চান না সুরঞ্জন জুলেখাকে বিয়ে করুক। জুলেখা বাড়ি আসে। মেয়েটি স্বভাব চরিত্রে ভালো, অমায়িক ভদ্র, ওর সঙ্গে কথা বলে তারও ভালো সময় কাটে, সবচেয়ে বড় কথা, সুরঞ্জন খুশি থাকে। চোখের সামনে দরজা বন্ধ করেই দুই বন্ধুতে সময় কাটায়, প্রেমের সম্পর্ক আছে বলেই কাটায়। কিরণময়ীর বরং মনে হয় বাজে ছেলে ছোকরাদের সঙ্গে মেশার চেয়ে ঘরে বসে প্রেম করা ভালো। বউ ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, একা পুরুষ মানুষ, সঙ্গী সাথী না থাকলে কি আর মন ভালো থাকে। কিরণময়ী এভাবে নিজেকে বোঝায়। মায়াকে বোঝায় কিন্তু মায়ার সাফ কথা, বিয়ের তো প্রশ্ন ওঠে না, এই মেয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না। মায়া কি খামোকা বলে! মায়ার কি মনে নেই দাঙ্গার সময় ঢাকার সেইসব দুঃস্বপ্নের কথা! মায়াকে ছিঁড়ে খায়নি ওই মুসলমানের বাচ্চাগুলো! মায়া পৃথিবীর সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারে, মুসলমানকে করবে না। যে মায়ার জন্য সুদেষ্ণার সঙ্গে তার বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটে গেল, সেই মায়াই কি না বলছে সুরঞ্জন যদি অন্য কোনও মেয়ের দেখা না পায়, তাহলে ওই সুদেষ্ণার কাছেই ফিরে যাক, সুদেষ্ণার সঙ্গে সম্পর্কটা নতুন করে জোড়া লাগিয়ে নিক সুরঞ্জন। সুদেষ্ণা বিয়ে থা করেনি আর। সুতরাং সম্ভাবনা তো আছেই। ওই মুসলমান মেয়ের সঙ্গে আজই এই মুহূর্তে সব সম্পর্ক ছিন্ন করুক সে।

কিরণময়ীর ঘরে বিছানায় বসে মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে এসব। কিরণময়ী চেয়ারে বসা। দরজায় দাঁড়ানো সুরঞ্জন। জানালার ওপাশে কলের তলে জল নেওয়ার হুল্লোড়। হু হু করে জানালার পর্দা উড়ছে। আশেপাশের কয়েকটি বাড়ি এখানে হিন্দু। কান্না যদি কেউ শুনতে চায়, কান পাতলেই শুনতে পাবে।

কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমার জীবনে সুখ আর হল না। মায়া তীক্ষ্ন চোখে তাকায় কিরণময়ীর দিকে, আমি না হয় দিইনি, তোমার নয়নের মণি পুত্র তোমাকে সুখ দিচ্ছে না কেন! এত জায়গা থাকতে এখানে এসে উঠেছো কেন! যত সব সন্ত্রাসীদের জায়গা।

দুদুটো বাড়ি পেরোলেই তো লাইন ধরে মুসলমানদের বাড়ি। এখানে কে দেবে নিরাপত্তা তোমাকে?

মায়া ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওই কান্নার দিকে তাকিয়ে সুরঞ্জনের খুব মায়া হয়। সে কী করবে বুঝতে পারে না। মায়া তার একটিই বোন, আদরের বোন। একসঙ্গে তাঁতিবাজারের বাড়িতে বড় হয়েছে। দাদা ছাড়া মেয়েটা কিছুই বুঝতো না। সেই বোনটা বুকে কী যন্ত্রণা পুষে যে কাঁদছে, সুরঞ্জন বোঝে। মায়ার প্রতিটি কথা, না-কথা, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, হাসি, সব জানে সে, কেন। যদি পারতো সুরঞ্জন জুলেখার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে, আজই করতো। না জুলেখা মুসলমান বলে নয়, শুধু মায়ার জন্য, মায়া চায় বলে। আর অন্য কোনও কারণ নেই। সুদেষ্ণার সঙ্গে হবে না তার। যে সম্পর্ক ভেঙে যায় ওভাবে, সামান্য টোকায়, ওই সম্পর্ক জোড়া লাগানোর কোনও অর্থ হয় না, ওটি যে কোনও সময়ই ভেঙে যাবে, সামান্য টোকায়। তার চেয়ে একা থাকা ভালো।

যখনই সে ভাবছে সুদেষ্ণার থাকার চেয়ে একা থাকা ভালো, এই কথা। তখনই মায়া বললো, তার চেয়ে দাদার একা থাকাই ভালো। থাকছে না লোকে! আমি যে থাকছি, ওই থাকা তো অনেকটা একা থাকার মতোই। বলে কেঁদে উঠলো মায়া। অনেকক্ষণ কাঁদে। কিরণময়ীর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদে। মায়ার কান্না ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই। কেউ তাকে থামতে বলে না। কারণ কারও অনুরোধ মায়াকে থামাতে পারবে না। মায়ার প্রয়োজন এখানে মায়ের বাড়িতে এসে তার জীবনের সব অতৃপ্তি আর অশান্তির জন্য প্রাণ খুলে কাঁদা। এই কান্নাটুকু না কাঁদলে তার পক্ষে সম্ভব হবে না সপ্তাহের বাকি কটা দিন না কেঁদে বাঁচা। বুকে অনেক কষ্ট সে পাথরের মতো জমিয়ে রাখে। মা আর দাদার সানি্নধ্যেই পাথর গলে নদী হয়। সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার আজ যদি অঢেল টাকা থাকতো, একটা ভালো এলাকায় বড় একটা বাড়ি ভাড়া নিত, মায়া আর দু বাচ্চাকে সে নিয়ে চলে আসতো নিজের কাছে। সুরঞ্জন নিজের জন্য নয়, কিরণময়ীর জন্য নয়, এমনকি জুলেখার জন্যও নয়, কেবল মায়াকে দেখলেই নিজের দারিদ্র্যের জন্য আফসোস করে। মায়াকে আগে একদিন সে বলেছে, ভালো একটা চাকরি পেতে পারতাম যদি, অথবা অনেক টাকা হয় এমন কোনও কাজ, তাহলে তোর আর কোনও কষ্ট হত না, তোকে আর থাকতে হত না ওই শয়তানের সঙ্গে। [ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর