শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

আরব্য রজনীর মহানায়ক (১৭ তম পর্ব)

গোলাম মাওলা রনি

আরব্য রজনীর মহানায়ক (১৭ তম পর্ব)

পারস্য সেনাপতি এয়ের পানি খাওয়ার আবেদন শুনে টার্ডিস ভারি আশ্চর্য হলেন। অতি দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হলো। হঠাৎ কেন পানির পিপাসা লাগল এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানালেন, গত রাতে তারা তিনজন স্বপ্নে প্রায় একই ঘটনা দেখেছেন। সকালে তারা পরস্পরের সঙ্গে স্বপ্ন নিয়ে আলোচনাও করেছেন; কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় তারা তা ভুলে গিয়েছিলেন। চলতি পথে টার্ডিসের কাছ থেকে রাজা আলেকজান্ডারের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং সিংহাসন লাভ নিয়ে ডেলফির মন্দিরের ভবিষ্যদ্বাণী এবং অন্যন্য অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা শোনার পর তাদের মনে পড়ে যায় গত রাতের স্বপ্নের কথা। আর তখনই ভয়, উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতায় হঠাৎ তৃষ্ণা পেয়ে বসে।

সেনাপতি টার্ডিস পারস্য সেনানায়কদের কথা শুনে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন- কী এমন স্বপ্ন দেখলেন যার কথা স্মরণ হওয়া মাত্র ভয়ে তৃষ্ণা পেয়ে বসল? তিনজনের মধ্যে সেনাপতি আমেন প্রথমে মুখ খুললেন। বললেন, সম্মানিত টার্ডিস! আমরা জানি না আমাদের নিয়তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! আমরা এও জানি না যে, আমরা পুরস্কৃত হতে যাচ্ছি নাকি তিরস্কৃত হতে যাচ্ছি? তবে গত রাতের স্বপ্ন বলে দিচ্ছে আপনাদের রাজা সম্ভবত আমাদের রাজ্য আক্রমণ করবেন পারস্যবাসী পরাজিত হবে এবং আমাদের সম্রাট নিহত হবে। প্রিয় মাতৃভূমি এবং দেশবাসীর নিদারুণ পরাজয় এবং পরিণতির কথা ভেবে আমরা হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে পড়েছি। টার্ডিস আর কথা না বাড়িয়ে রাজা আলেকজান্ডারের খাস কামরার দিকে পা বাড়ালেন।

রাজার কামরায় প্রবেশ করে সবাই মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন পারস্যের সেনাপতিত্রয় এই প্রথম অন্তরে শ্রদ্ধা নিয়ে বিনত নয়নে রাজার পানে তাকালেন। ২০ বছরের তরুণের রাজকীয় অভিব্যক্তি এবং তার ব্যক্তিত্ব থেকে ঝিলিক মেরে বের হওয়া এক মহাজাগতিক আকর্ষণ তাদের দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তুলল। রাজা ইঙ্গিতে তাদের সংরক্ষিত আসনে বসতে বললেন। কোনোরকম ভূমিকা না করেই জিজ্ঞাসা করলেন, কেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন? প্রশ্ন শুনে সেনাপতিরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমতা আমতা করতে শুরু করলেন, তারপর ধীরে ধীরে বর্ণনা করলেন পারস্যের নতুন সম্রাটের ক্ষমতা গ্রহণের ইতিবৃত্ত, প্রধানমন্ত্রী বাগোয়াসের কাহিনী, গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্টনমেন্টগুলো সরিয়ে ফেলা নিয়ে সেনাবাহিনীর অসন্তোষ এবং সর্বোপরি নিজেদের পালিয়ে আসার কাহিনী। সবকিছু শোনার পর আলেকজান্ডার সেনাপতিদের কাছে জানতে চান যে তারা কিভাবে মেসিডোনিয়ায় থাকতে চান? রাজা যদি তাদের প্রকাশ্যে আশ্রয় দেন সেক্ষেত্রে পারস্য সম্রাট মেসিডোনিয়া আক্রমণের সুযোগ পাবে। অন্যদিকে তাদের যদি গ্রেফতার করা হয় সেক্ষেত্রে পারস্য সম্রাট হয়তো আসামিদের ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানাবেন। এ অবস্থায় রাজার করণীয় সম্পর্কে আলেকজান্ডার পারস্য সেনাপতিদের পরামর্শ জানতে চাইলেন।

রাজা আলেকজান্ডারের নমনীয় আচরণ, কূটনৈতিক উপস্থাপনা এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে পারস্যের সেনাপতিদের পূর্বাপর মনোভাব, দম্ভ, স্বদেশপ্রেম এবং আভিজাত্যবোধ মারাত্মকভাবে হোঁচট খেল। তারা একে অপরের প্রতি তাকাতে লাগলেন এবং যুৎসই কোনো উত্তর না পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন। এ অবস্থায় সেনাপতি নজভী তার অপর দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন- আমার বন্ধুরা! এবার আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, আমরা সত্যিকার অর্থেই মারাত্মক এক মসিবতের মধ্যে পড়েছি। আমাদের পক্ষে দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের উচিত সদাশয় রাজার দয়ার ওপর নিজেদের সমর্পণ করা। এ কথা বলে তিনি রাজার সামনে গিয়ে পুনরায় বললেন, হে আমাদের সদাশয় মালিক! আমরা আত্মসমর্পণ করলাম। আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করুন। আপনি আমাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন এবং আপনার সেবাদাস হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। ইচ্ছা হলে আমাদের হত্যা কিংবা আপনার রাজ্য থেকে বহিষ্কার করতে পারেন; কিন্তু অনুগ্রহ করে আমাদের ফেরত পাঠাবেন না।

সেনাপতিদের কথা শুনে রাজা আলেকজান্ডারের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি আসলে এমনটিই চাচ্ছিলেন। কথা না বাড়িয়ে রাজা উঠে দাঁড়ালেন এবং তার সেনাপতি টার্ডিসকে ডেকে হুকুম দিলেন পারস্য সেনাপতিদের মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। তারপর তারা চাইলে মেসিডোনিয়ায় থাকতে পারবেন নয়তো চলে যেতে পারবেন যে কোনো দেশে। তারা চাইলে মেসিডোনিয়ান বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরিও নিতে পারেন অথবা স্বাধীন নাগরিকের মতো অন্য যেকোনো কাজও করতে পারেন। রাজার নির্দেশ শুনে সেনাপতিরা যারপরনাই খুশি হলেন এবং অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে রাজি হয়ে গেলেন। আর এভাবেই শুরু হয়ে গেল বিশ্ব ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণের যুগান্তকারী ঘটনা।

সিংহাসন লাভের সময় রাজা আলেকজান্ডারের বয়স ছিল ২০ বছর আর সনটি ছিল ৩৩৬ খ্রিঃ পূর্বাব্দ। প্রথম এক বছর তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সুসংবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ঠিক এ সময়টিতেই তিনি পারস্যের তিনজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সন্ধান এবং সাহায্য লাভ করেন। তারপর জেনে নেন পারস্য সাম্রাজ্যের খুঁটিনাটি দুর্বলতাগুলো এবং একইসঙ্গে শক্তিমত্তাগুলো। তিনি পরবর্তী দুই বছর ধরে নিজেকে এবং নিজের বাহিনীকে ইউরোপ এবং আফ্রো এশীয় ধাঁচের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন। এক্ষেত্রে পারস্য সেনাপতিরা তাকে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকেন। অবশেষে তিনি পারস্য অভিযানে বের হন ৩৩৪ খ্রিঃ পূর্বাব্দে যখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর আর অধীনস্থ সৈন্যসংখ্যা ৫০ হাজার। ১০ হাজার সৈন্য রেখে যান মেসিডোনিয়া রক্ষার জন্য, বাকি ৪০ হাজার নিয়ে বের হন বিশ্ববিজয়ে। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যের দখল সম্পন্ন করেন। ৩৩১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে পারসিকদের রাজধানী পার্সিপোলিকে আগুনে ভস্মীভূত করার মাধ্যমে তিনি তার বিজয় উৎসব পালন করেন।

আমিরুল মুমেনীন তার নতুন রাজধানী রাক্কার শাহী মসজিদের প্রাঙ্গণে বসে সম্রাজ্ঞী জুবায়দাকে বলছিলেন নিজের জন্মস্থান রে নগরীর আদিঅন্ত, অরক্ষিত রে নগরীর মধ্য দিয়ে সম্রাট আলেকজান্ডার কিভাবে পারস্যে প্রবেশ করেছিলেন সেই সম্পর্কে এবং সর্বোপরি তার মা আল খায়জুরান সম্পর্কে। নতুন প্রাসাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগে তিনি মসজিদে গিয়ে শুকরিয়ার নামাজ পড়তে পড়তে তার স্নেহময়ী আম্মা হুজুরের সীমাহীন পরিশ্রম, আত্মত্যাগ এবং তাকে খলিফা বানানোর প্রাণান্তকর চেষ্টার কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বেদনার কিছুটা অংশ হালকা লাঘব করার অংশ হিসেবে বিভিন্ন কথা বলে সময় পার করছিলেন। বিদূষী সম্রাজ্ঞী সবকিছু বুঝলেন এবং অসীম ধৈর্য সহকারে খলিফার সব কথা শোনার পর শুধু বললেন- হে আমিরুল মুমেনীন! আপনি সদয় হলে আমরা অনুষ্ঠানস্থলের দিকে রওয়ানা করতে পারি।

খলিফা উঠে দাঁড়ালেন এবং সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থলের দিকে রওয়ানা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে সানাই নহবত বেজে উঠল। নকীব ঘোষণা করল- হুঁশিয়ার! সাবধান! আমিরুল মুলক ! সাহেবে আলম! বাদশাহে নামদার, মুসলমানদের চোখের মণি, মাথার তাজ আমিরুল মুমেনীন খলিফা হারুন আল রশিদ হাজির ! মুহূর্তের মধ্যে সব কোলাহল বন্ধ হয়ে গেল। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়ালেন এবং আহলান সাহলান বলে খলিফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। উজিরে আজম জাফর ইবনে ইয়াহিয়া সামনে এগিয়ে এলেন এবং কুর্নিশ অন্তে খলিফার ডান হাত চুম্বন করলেন। তার দেখাদেখি একে একে সারিবদ্ধভাবে অন্যান্য আমির ওমরাহরা এগিয়ে এলেন এবং উজিরে আজমের অনুকরণে খলিফার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেন। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে খলিফা তার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন। উজিরে আজম খলিফার অনুমতি নিয়ে সমবেত অতিথিদের উদ্দেশে কিছু বলতে চাইলেন। খলিফা হাত তুলে ইশারা দিলেন বক্তব্য পেশ করার জন্য। উজিরে আজম বলতে শুরু করলেন, সম্মানিত আমিরবৃন্দ এবং পর্দার আড়ালের সম্মানিতা মহিলাগণ! মহান আল্লাহর দরবারে লক্ষ কোটি শুকরিয়া এবং সরোয়ারে কায়েম, আহমাদে মোস্তফা মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর রওজায় লক্ষ কোটি সালাম। গভীর শ্রদ্ধা, বিনয় এবং আনুগত্য আমাদের মহান খলিফার প্রতি এবং সাম্রাজ্যের মালেকা ই আলেয়া মহীয়সী যুবায়দার প্রতি। আজকের সুখময় পবিত্র দিনে সাম্রাজ্যের উজিরে আজম হিসেবে দুটি খুশির সংবাদ আপনাদের অবগত করার জন্য আমি উপস্থাপন করতে চাই। প্রথম সুসংবাদটি কেবল আমাদের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। আমাদের মহান খলিফার দয়া, প্রজ্ঞা, নির্দেশনা এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তির কারণে আমরা এমন একটি জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি যা তাবৎ দুনিয়ার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার ইতিহাস পাল্টে দেবে। এই সুমহান কর্ম এবং আবিষ্কারের জন্য তামাম দুনিয়া কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের কাছে বিশেষ করে আমাদের আমির উল মুমেনীনের কাছে ঋণী থাকবে।

উজিরে আজম তার বক্তব্যের এ পর্যায়ে হঠাৎ দুই হাতে তালি বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন প্রহরী খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে একটি সুদৃশ্য স্বর্ণ নির্মিত ছোট্ট বাক্স গার্ড অব অনার দিয়ে সভাস্থলে নিয়ে এলো। উজিরে আজম অত্যন্ত তাজিমসহকারে বাঙ্টি স্পর্শ করলেন এবং নিজের হাতে নিজেই চুমো খেলেন। উপস্থিত আমির ওমরাহগণ কোনো কিছু না বুঝে অস্থিরতা এবং অধীরতা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্য। উজিরে আজম এবার বাঙ্টি খুললেন এবং ভাঁজ করা সাদা ফকফকা কাপড়ের মতো কি যেন বের করে সবার সামনে মেলে ধরলেন। তারপর চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, আপনারা কি কেউ বলতে পারবেন এটা কি? কিংবা এটা দিয়ে কি করা হবে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, হে উজিরে আজম! আমরা কিছুই জানি না। উজিরে আজম এবার বাঙ্টির মধ্যে হাত দিয়ে আরেক খণ্ড সাদা বস্তু বের করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে তা খলিফার হাতে সমর্পণ করলেন। খলিফা মুচকি হেসে তা গ্রহণ করলেন এবং পরম আগ্রহ এবং তাজিমসহকারে বস্তুটিকে চুম্বন করলেন।

উজিরে আজমের উপস্থাপনা, বর্ণময় বর্ণনা এবং খলিফার চুম্বন করার দৃশ্য দেখে উপস্থিত মেহমানদের কৌতূহল শতগুণ বেড়ে গেল। বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি এবং একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার তা নিয়ে কারুরই সংশয় ছিল না। কিন্তু তারা জিনিসটি কি হতে পারে সে ব্যাপারে কিছুই অনুমান করতে না পেরে আল্লাহকে ধন্যবাদ এবং নিজেদের অজ্ঞানতা জাহির করার জন্য বলতে থাকলেন, মারহাবা ইয়া মারহাবা! সুবাহান আল্লাহ! সুবাহান আল্লাহ! আল্লাহই সত্য! বাকি সব মিথ্যা! লোকজনের আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখে উজিরে আজমের উৎসাহ বহুগুণে বেড়ে গেল। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় বড় কয়েকটি নিঃশ্বাস নিলেন তারপর জোরে জোরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! রব্বানা লাকাল হামদ! হামদান কাছিরান! তৈয়্যেবান! মুবারাকান ফিহি! এরপর মাথা নামিয়ে সমবেত সুধীজনের দিকে মুখ ঘোরালেন এবং বললেন, আমাদের এই মহামূল্যবান আবিষ্কারটির নাম কাগজ। আমরা শুধু কাগজই আবিষ্কার করিনি, কাগজ বানানোর কলও আবিষ্কার করেছি।

আমি এখন কাগজের ব্যবহার এবং এর আবিষ্কারের ইতিকথা আপনাদের শোনাব। আপনাদের নিশ্চয়ই তালাসের যুদ্ধের কথা মনে আছে যা আমরা করেছিলাম সেই ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে। ভয়াবহ সেই যুদ্ধটি হয়েছিল তালাস নদীর তীরে। আমাদের সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য প্রদেশ তারাজ এবং তালাস (আধুনিক কাজাকিস্তান ও কিরঘিস্তান) সীমান্তে চীন সম্রাট ঝুয়ানজংয়ের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধের পরিণতিতে বিশ্বে তাৎক্ষণিকভাবে দুটি যুগান্তকারী মীমাংসা সাধিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীনের সুবিখ্যাত রাজবংশ তাং সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। অন্যদিকে যুদ্ধে জয়লাভ করে বাগদাদে আব্বাসীয় খিলাফতের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল। আর সেই যুদ্ধ জয়ের সূত্র ধরে আজ এত বছর পর অর্থাৎ ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে আপনাদের তথা বিশ্ববাসীকে কাগজ আবিষ্কারের মতো যুগান্তকারী ঘটনা উপহার দিতে পারছি।

আপনারা হয়তো অধীর আগ্রহ নিয়ে আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করার জন্য মুখিয়ে আছেন যে, তালাসের যুদ্ধের সঙ্গে কাগজ আবিষ্কারের কি সম্পর্ক। তা ছাড়া যুদ্ধ হয়েছিল সেই ৭৫১ সালে। আজ ৪৫ বছর পর সেই যুদ্ধের সূত্রে কিরূপে কাগজ আবিষ্কার হবে? আর কাগজের ব্যবহারই বা কি? এটা মানব সমাজের কি এমন কাজে লাগবে? আপনারা দয়া করে অপেক্ষা করুন এবং আমাকে একটু সুযোগ দিন। আমি একে একে সব কথা এবং পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আপনাদের কাছে বর্ণনা করব ইনশাআল্লাহ। বক্তব্য শুরু করার আগে আমি সেই আল্লাহর সাহায্য চাই যিনি কিনা সব হেকমতের মালিক। ঘটনাটির শুরু হয়েছিল চীন দেশে। সম্রাট ঝুয়ানজং ছিলেন তাং সাম্রাজ্যের সপ্তম সম্রাট। আর তার রাজত্ব শুরু হয়েছিল ৭১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন মহান শাসক, দক্ষ যোদ্ধা এবং অতি উত্তম প্রকৃতির মানুষ। এই সময় থেকে তিনি মানবজাতির লেখার জন্য কাগজ আবিষ্কারের কথা চিন্তা করতে থাকেন। সাম্রাজ্যের সবখান থেকে নামিদামি বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদদের নিমন্ত্রণ করে তিনি রাজধানীতে নিয়ে আসেন।

তার রাজধানীর নাম ছিল চাঙ্গান যার অর্থ হলো অন্তহীন শান্তি [Perpetual peace শহরটির বর্তমান নাম জিয়ান যা কিনা সানঝি প্রদেশের রাজধানী]।

সম্রাট ঝুয়ানজং শেষ বয়সে এসে তার কয়েকজন উজিরের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে লি লিনফু, ইয়াং গওঝং এবং অ্যান লুসান ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। তারা বৃদ্ধ সম্রাটকে রীতিমতো মানসিক চাপে রাখতেন এবং তাদের সব অন্যায় আবদার এবং অন্যায্য সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য করতেন। তারা সম্রাটকে বাধ্য করেন কাগজ প্রকল্প বন্ধ করার জন্য এবং প্রকল্পের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিজ্ঞানীদের জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে একীভূত করে নেওয়ার জন্য। প্রকল্পটি এমন এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হলো যখন তারা কাগজ আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সম্রাটের কোনো উপায় ছিল না উজিরদের পরামর্শ পরিহার করার। তাই তিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে প্রকল্পটি বন্ধ করার রাজকীয় ফরমানে স্বাক্ষর করলেন। এ ঘটনার পর সম্রাট দিনকে দিন বিমর্ষ হতে থাকলেন। চীন দেশের ইতিহাসে এটাকে বলা হয় তিয়ানবাও এরা (৭৪২-৭৫৬) এই সময়টাতে সম্রাট অতি মাত্রায় সুন্দরী রমণীদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার সুন্দরী যুবতী, কিশোরী এবং বালিকাদের ধরে এনে তার হেরেম পরিপূর্ণ করে ফেলা হয়। এসব মেয়ের আর্তচিৎকারেই সম্ভবত আল্লাহর গজব নেমে এলো ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে সে এক লম্বা কাহিনী! যা কিনা একাধারে ছিল হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক এবং যুগান্তকারী। (চলবে)

 

 

সর্বশেষ খবর