শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

আরব্য রজনীর মহানায়ক (১৮ তম পর্ব)

গোলাম মাওলা রনি

আরব্য রজনীর মহানায়ক (১৮ তম পর্ব)

তালাসের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল কিন্তু একটি নদীকে উপলক্ষ করে যার নাম সির দরিয়া। মধ্য এশিয়ায় দরিয়া বলতে সাধারণত বড় নদীকে বুঝানো হয়। তালাস রাজ্যের (কিরঘিস্তান) তিয়ানশান পর্বতমালা থেকে উৎসারিত হয়ে সির দরিয়া উত্তর-পশ্চিমে ১৩৭৪ মাইল পথ প্রবাহিত হতে হতে আরাল সাগরে পতিত হয়। আরাল সাগর হলো পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদগুলোর মধ্যে অন্যতম যা কিনা দুইটি নদীর কল্যাণে বেঁচে আছে অনাদীকাল থেকে। একটির নাম সির দরিয়া, আর অন্যটির নাম আমু দরিয়া। আমু দরিয়া, সির দরিয়া ও আরাল সাগরকে কেন্দ্র করে চলে গেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং প্রধানতম বাণিজ্যিক পথ সিল্ক রুট- যার মাধ্যমে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার লোকেরা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত করত।

মূলত সিল্ক রুটের বৃহত্তর অংশের ওপর আধিপত্য বজায় রাখার জন্য চীনের তাং সম্রাটরা তাদের রাজ্য থেকে পশ্চিমদিকে অর্থাৎ মধ্য এশিয়ায় একের পর এক সৈন্য সমাবেশ করে আসছিলেন এবং অনেক রাজ্য জয় করতে করতে তালাস পর্যন্ত এসে থেমে ছিলেন। আর এই সময়টাই ছিল সম্রাট ঝুয়াংজংয়ের রাজত্বের দুর্বলতম ক্ষণ যখন কিনা তিনি প্রভাবশালী আমির-ওমরাহদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নিজে মেতে উঠেছিলেন সীমাহীন ভোগ-বিলাস এবং মর্মান্তিক সব অনাচারে। এসব অনাচারের মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছিল তার নারীপ্রীতি এবং বিকৃত যৌনাচার। অভিজাত পরিবারের সুন্দরী কিশোরীদের তিনি জোরপূর্বক তুলে নিয়ে আসতেন। হতভাগ্য সেই সব কিশোরীদের অসহায় পিতা-মাতা হয় আল্লাহর দরবারে নালিশ জানাতেন নয় তো পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে গিয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতেন।

তাং সাম্রাজ্য যখন দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার, ব্যভিচার এবং কুশাসনের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে নুয়ে পড়ছিল ঠিক তখনই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যটি প্রায় একই কারণে ধ্বংস হয়ে গেল। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে যাবের যুদ্ধে উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জায়গায়ও নদীই ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় সবকিছু। যাব নদীর তীরেই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল। ছোট একটি নদী যা কিনা কুর্দিস্তান থেকে উৎপন্ন হয়ে মাত্র ২৫০ মাইল প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ মেসোপটিমিয়ার (ইরাক) মসুলের কাছে তাইগ্রিস নদীতে মিশেছে সেটিই হয়ে গেল আব্বাসীয়দের উত্থান এবং উমাইয়াদের পতনের নিয়ামক, ঠিক যেমনটি হয়েছিল তালাস প্রান্তরে তাং সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে।

৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারির ব্যাটেল অব দি যাব-এর মাধ্যমে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রায় ৯০ বছরের পুরনো উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতন হলো। নতুন খলিফা হলেন আবুল আব্বাস আস সাফ্ফাহ। তিনি পূর্বতন রাজধানী দামেস্ক দখল করার পর পরই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন কতিপয় অভিজাত চীনা সামন্ত রাজা। তারা অনেকদিন আগেই মুসলমান সাম্রাজ্যে এসেছিলেন তাং সম্রাটের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর জন্য। তারা মূলত উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের দরবারে এসেছিলেন ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আনাতোলিয়া, মধ্য এশিয়ার তারাজ ও তালাস (কাজাকিস্তান ও কিরঘিস্তান), আন্দালুসিয়ার কিয়দাংশ, ভারতবর্ষের সিন্ধু এবং ব্যাকটেরিয়া অঞ্চলের বিরাট অংশ তখন দামেস্কের অধীন। এই সুবিশাল সাম্রাজ্য তখন পতন জ্বরে আক্রান্ত। সর্বত্রই চলছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, খুন-খারাবি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ। চীনা নেতারা এই অবস্থায় খলিফার সঙ্গে দেখা না করে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রাজধানীতে বসে অলস সময় পার করতে লাগলেন দুটি কারণে। প্রথমত তাদের মনে হচ্ছিল খুব তাড়াতাড়ি উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতন হবে। দ্বিতীয়ত পতন যদি না-ও হয় তবুও খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান তার সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে চীনাদের কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শুনবেন না।

খুব বেশিদিন চীনাদের অপেক্ষা করতে হয়নি। সম্ভবত ৫-৬ মাস পরই তারা দেখতে পেলেন আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস আস সাফ্ফাহকে নতুন ক্ষমতার মসনদে। তারা আর অপেক্ষা না করে একদিন হুট করে হাজির হয়ে গেলেন খলিফার দরবারে। খলিফার পাত্র-মিত্র-উজির-নাজির সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে চীনা নেতারা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন কিভাবে তাং সম্রাটের বাহিনী সির দরিয়ার উপকূল ঘেঁষে ধীরে ধীরে মুসলিম ভূখণ্ডের দিকে এগুচ্ছে। তারা যদি মধ্য এশিয়ার সিল্ক রুটের দখল নিতে পারে তবে মুসলমানদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। খলিফা সব কথা মনোযোগ সহকারে শোনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধ যাত্রার।

সির দরিয়া এবং সিল্ক রুটের আধিপত্য নিয়ে মনস্তাত্তি্বক বিরোধ, চীনা সামন্ত প্রভুদের আমন্ত্রণ এবং সর্বোপরি যুদ্ধজয়ী একটি বিশাল বাহিনীকে ব্যস্ত রাখার জন্য খলিফা তাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করলেন। উভয়পক্ষের সৈন্যরা তালাস নদীর তীরে পরস্পরের মুখোমুখি হলো। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই লাখ। অন্যদিকে চীনাদের ছিল মাত্র এক লাখ। ৭৫১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মাত্র একদিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে চীনা বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। বেশির ভাগ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়। বাকিরা হয় বন্দী। এতবড় ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার ক্ষমতা তাং সম্রাটের ছিল না। সারা সাম্রাজ্যে শুরু হয় গগনবিদারী হাঁ-হুতাশ এবং আহাজারি। এ অবস্থায় সম্রাটের লোকজন প্রচার করতে থাকে যে, যুদ্ধে তাদের মাত্র ১০ হাজার লোক মারা গেছে। আর তারা মাত্র ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে তালাস প্রান্তরে গিয়েছিল। এদের মধ্যে ১০ হাজার চীনা সৈন্য এবং বাকি ২০ হাজার হলো চীনাদের বন্ধু কার্লুক সম্প্রদায়ের যোদ্ধা। রাষ্ট্রযন্ত্রের মিথ্যা প্রচার জনগণ বিশ্বাস করল না। শুরু হলো রাজ্যময় গণঅসন্তোষ এবং বিদ্রোহ। শেষ পর্যন্ত তাং সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যদিয়ে গণবিদ্রোহের যবনিকাপাত হলো।

তালাস প্রান্তর থেকে হাজার হাজার চীনা যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে আসা হলো দামেস্কে। অনেককে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হলো, অনেককে করা হলো বিক্রি এবং কাউকে কাউকে প্রেরণ করা হলো কারাগারে। মহান খলিফা আল মনসুরের শাসনামলের কোনো এক সময় শাহজাদা হারুন আল রশিদ কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে সন্ধান পেলেন কয়েকজন চীনা বিজ্ঞানীর, যারা বহুদিন ধরে সম্রাট ঝুয়ানজংয়ের কাগজ প্রকল্পে কাজ করে আসছিলেন। তারা শাহজাদাকে কাগজের ব্যবহার, নির্মাণ কৌশল এবং প্রকল্পের খুঁটিনাটি নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত জানালেন। কিশোর শাহজাদা তার সহজাত মেধা এবং প্রকৃতি প্রদত্ত প্রজ্ঞার মাধ্যমে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। কারাগার থেকে ফিরে আসার পর তিনি তার ধর্মপিতা এবং সাম্রাজ্যের উজিরে আজম ইয়াহিয়া বার্মেকিকে বিস্তারিত জানালেন। বিষয়টি অতিদ্রুত খলিফা আল মনসুরের কানেও গেল। ঘটনার পর শাহজাদা ঘন ঘন কারাগার পরিদর্শনে যাওয়া শুরু করলেন এবং কাগজ উৎপাদন প্রকল্প শুরু করার জন্য উতলা হয়ে পড়লেন। শাহজাদার উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আগ্রহের কারণে চীনা বিজ্ঞানীদের কারাগার থেকে মুক্ত করা হলো এবং রাজকীয় অর্থায়নে রাজধানী বাগদাদ নগরীতে চালু হলো কাগজ প্রকল্প।

উজিরে আজম জাফর ইবনে ইয়াহিয়া নতুন রাজধানী রাক্কার শাহী প্রাসাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কাগজ আবিষ্কার এবং একইসঙ্গে কাগজ নির্মাণের যন্ত্র আবিষ্কারের ইতিকথা বর্ণনা করার পর কাগজের ব্যবহার সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। সমবেত আমন্ত্রিত অতিথিরা মুসলমানদের এহেন যুগান্তকারী আবিষ্কার এবং যুগপৎ সফলতার কথা শুনে বার বার শিহরিত হলেন । খলিফার জন্য নির্ধারিত কুরসিতে বসে আমিরুল মুমেনীন খুশিতে আত্মহারা হয়ে বার বার মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছিলেন। তখন পর্যন্ত খলিফার সাম্রাজ্যে সাকুল্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র শতকরা আটজন। বাকি বিরানব্বইজনই ছিলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, অগি্ন উপাসক, পৌত্তলিক প্রভৃতি ধর্মের অনুসারীরা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক নাস্তিকের বসবাস ছিল সমগ্র রাজ্যময়। খলিফা রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে অনুসরণ করলেও অন্য ধর্মের মতাবলম্বীদের স্বাধীনতা রক্ষা করতেন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও শক্তিমত্তা দিয়ে। অন্যের ধর্মানুভূতিতে যেন সামান্যতম আঘাত না লাগে সে জন্য খলিফা নিজে তার শরীর বিশেষ করে ঠোঁট ও জিহ্বার ব্যবহার সম্পর্কে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। কোনো কিছু লিখতে গিয়েও তিনি সংবেদনশীল বিষয়সমূহের ব্যাপারে সযত্ন খেয়াল রাখতেন। তার দরবারে নাচগান হতো না বললেই চলে। কেবল শাহী হেরেমের জেনানা মহলে নারীদের অংশগ্রহণে নৃত্যগীত হলে খলিফা পদাধিকার বলে মাঝেমধ্যে উপস্থিত থাকতেন।

প্রকাশ্য রাজদরবারে মাঝেমধ্যে বসত কবিতা পাঠের আসর। হতো বিতর্ক প্রতিযোগিতা। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কের অনুষ্ঠানগুলো। এসব বিতর্ক একবার শুরু হলে তা চলত ধারাবাহিকভাবে দিনের পর দিন কিংবা রাতের পর রাত ধরে। প্রত্যেক বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত বিতর্কে বিজয়ীরা আবার ঐক্যবদ্ধ করে রাখা হতো একটি সমিতির মাধ্যমে যার নাম ছিল বাইত আল হিকমা বা হাউস অব উইজডম। স্বয়ং আমিরুল মুমেনীনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাইত আল হিকমা পরিচালিত হতো। একটি সুবিশাল কমপ্লেক্সে লাইব্রেরি, গবেষণাগার, মিলনায়তন, উন্মুক্ত মাঠ, অতিথিশালা, রন্ধনশালা, মনোরম উদ্যান, মসজিদ, সভামঞ্চ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বায়ত আল হিকমা ছিল তৎকালীন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষদের সম্মিলন কেন্দ্র।

সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার জাতি-গোষ্ঠীর লোক দল বেঁধে বাইত আল হিকমাতে আসতেন তাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা, গান, কীর্তিগাথা পরিবেশন করার জন্য। কেউবা আসতেন তাদের গোত্র, দেশ বা জাতির বীরত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব বর্ণনা করার জন্য। অনেকে আসতেন তাদের অনুসৃত ধর্ম নিয়ে আলোচনার জন্য। বাইত আল হিকমার রাজকীয় কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় খরচে এসব লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয় উপস্থাপনের সুযোগ দিতেন। প্রতিটি বিষয় অবলোকন, পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন করার জন্য ছিল একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি। এ কমিটির বিবেচনায় কোনো একটি উপস্থাপনা বা পরিবেশন যদি অতিশয় উৎকৃষ্ট এবং কাঙ্ক্ষিত মানের হতো তবে তা দ্বিতীয়বার আয়োজন করা হতো স্বয়ং খলিফার সামনে। খলিফার উপস্থিতিতে সেসব বর্ণাঢ্য আয়োজনে মাঝেমধ্যে ঘটতো নানারকম রুহানি, শরিয়তি কিংবা মারফতি ঘটনা।

একবার এমনি এক ঘটনায় পুরো বাগদাদ নগরীতে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল।

ঘটনার দিন আকাশ ছিল অদ্ভুতরকম স্বর্ণালী সুন্দর। পড়ন্ত বিকালে বাইত আল হিকমার উন্মুক্ত প্রান্তরে হাজার হাজার জনতার সামনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মল্লযুদ্ধ। সাম্রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে মল্লবীরেরা এসেছেন রাজধানীতে। কয়েকটি পর্বে তারা একে অপরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য মাত্র চারজন টিকে আছেন। এ চারজন আজ আমিরুল মুমেনীনের সামনে যুদ্ধ করবেন। তিনজন বাদ পড়বেন এবং শেষমেশ টিকে থাকবেন একজন। প্রথা অনুযায়ী চূড়ান্ত বিজয়ী ব্যক্তি শেষমেশ উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে চ্যালেঞ্জ জানাবেন- কেউ কি আছেন? যার বুকের পাটা রয়েছে আমার সঙ্গে লড়াই করার? কেউ যদি এগিয়ে আসেন সাহস করে তবে তাকে পরাজিত করতে হবে। সাধারণত জনতার মধ্য থেকে কেউ এগিয়ে আসত না। কারণ মল্লবীর ইচ্ছা করলে আছাড় দিয়ে তার প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলতে পারত এবং তার এ ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হতো না। মূলত প্রতিযোগিতাকে নিরঙ্কুশ অথচ উটকো ঝামেলামুক্ত করার জন্য এ নিয়মের প্রচলন করা হয়েছিল। চূড়ান্ত বিজয়ী বীরকে রাজকীয় মল্লবীর উপাধি প্রদান করা হতো যা কিনা বলবৎ থাকত পরবর্তী এক বছরের জন্য। পরবর্তী বছর তাকে অনুরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে টিকে থাকতে হতো নতুবা সসম্মানে পদত্যাগ করে সরে পড়তে হতো। রাজকীয় মল্লবীর পুরস্কার হিসেবে পেতেন এককালীন বিরাট অঙ্কের নগদ অর্থ, সারা বছরের খোরপোষ এবং রাজদরবারের নিয়মিত সদস্য হিসেবে আসনগ্রহণের দুর্লভ সম্মান।

ঘটনার দিন যে মল্লবীর সবাইকে পরাজিত করে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন তিনি এর আগে পর পর তিন বছর ধরে রাজকীয় মল্লবীরের পদ অধিকার করে রেখেছিলেন। তার বীরত্ব রাজ্যময় স্বীকৃত এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বমহলে প্রশংসিত।

সবাই ধরে নিলেন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে তিনিই হতে যাচ্ছেন চতুর্থবারের মতো রাজকীয় মল্লবীর। জনগণ মুহুর্মুুহু করতালি দিয়ে তাকে সমর্থন জানাতে লাগল এবং হর্ষধ্বনি দিয়ে আশপাশে তাকাতে লাগল। হঠাৎ ঘটে গেল ইতিহাসের মহা আশ্চর্যজনক এক ঘটনা। এক জীর্ণশীর্ণ, দরিদ্র এবং বয়োবৃদ্ধ আরব লোক জনতার মাঝ থেকে এগিয়ে এলেন লড়াই করার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে হৈচৈ ও করতালি বন্ধ হয়ে গেল। বিচারকরা নড়েচড়ে বসলেন। স্বয়ং আমিরুল মুমেনীনও আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন বৃদ্ধ আরব লোকটি কি সুস্থ আছেন নাকি উন্মাদ! বৃদ্ধের কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

তিনি তার দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে মল্লবীরের দিকে এগুতে আরম্ভ করলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে। অন্যদিকে মল্লবীর এ অদ্ভুত আশ্চর্য ঘটনা দেখে রাগে-অভিমানে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। উপস্থিত জনতা ভাবল- এবার আর বোকা বৃদ্ধের রক্ষা নেই। রাজকীয় বীর একটি আছাড় দিয়ে বৃদ্ধকে আলুভর্তা বানিয়ে ফেলবেন। তারা গবেষণা শুরু করল, বৃদ্ধ কখন মরবেন? মল্লবীর তার টুঁটি চেপে ধরে যখন তাকে আছাড় দেওয়ার জন্য উপরে তুলবেন তখন? নাকি আছাড় মারার পর জমিনে পতিত হয়ে আলুভর্তা হবেন তখন? (চলবে)

 

 

সর্বশেষ খবর