শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ও তার অমর একুশে গানের উপাখ্যান

মোনায়েম সরকার

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ও তার অমর একুশে গানের উপাখ্যান

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে কারফিউ ভাঙার সময় ভাষাশহীদ রফিকের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সংবেদনশীল হৃদয়ে অনুরণিত হয়- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' ত্রিশ পঙ্ক্তির এই অমর গানটি লিখতে তার ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি তিন দিন সময় লেগেছিল। কিন্তু এই গানটির প্রথম ছয় পঙ্ক্তি মাত্র গাওয়া হয়।

একদিন একান্ত আলাপচারিতায় একুশের গান সম্পর্কে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আমাকে যা বলেছিলেন তা ছিল অনেকটা এরকম- "একুশ তারিখ দুপুরে ঢাকায় তখনকার প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবনের (জগন্নাথ হল) সামনে গুলিবর্ষণ হয়ে গেছে। শহীদ রফিকের লাশ পড়ে আছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরের বারান্দায়। তার মাথার খুলি উড়ে গেছে গুলিতে। খবর পেয়ে কয়েকজন বন্ধুসহ আবদুল গাফ্‌ফার ছুটে যান সেই লাশ দেখতে। শহীদ রফিকের লাশ দেখেই তার মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি কবিতার লাইন শোকাবেগে গুঞ্জরিত হলো- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'। শহীদের মৃতদেহের ছবি তুললেন রফিকুল ইসলাম। হাসপাতালের পাশে মেডিকেল কলেজের ব্যারাক-হোস্টেলের সামনে (এখন যেখানে শহীদ মিনারটা) মানুষটি তার প্রায় সমবয়সী হবেন। একটা সাইকেলে চেপে তখন সারা শহর টহল দেন। তাকে দেখে বললেন, গাফ্‌ফার মিছিলে ছিলেন? তিনি বললেন, ছিলাম। গুলি শুরু হতেই মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর পালিয়ে এসেছি। এখন হাসপাতালের আউটডোরের মেঝেতে একজন শহীদের মৃতদেহ দেখে এলাম। তাকে দেখে মনে হয়েছে, আমার আপন ভাই। মনে একটা কবিতার লাইনও তৈরি হয়ে গেছে, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।' কবিতার লাইনটি শুনেই আহমদ হোসেন তার হাত চেপে ধরলেন। বললেন, কবিতাটি এখনই লিখে ফেলুন। তিনি বললেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি কবিতা লেখা যায়? হোস্টেলে ফিরে গিয়ে লিখব। আহমদ হোসেন বললেন, আপনি হেঁটে আরমানিটোলা পর্যন্ত যেতে কবিতাটি হারিয়ে যাবে। আপনি আমার সাইকেলটা নিন। তাড়াতাড়ি হোস্টেলে গিয়ে কবিতাটি লিখুন।

তিনি তখন ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। কলেজ ভবন তখন পুরনো ঢাকায় সিদ্দিকবাজারে। শহরের এখানে-সেখানে সরকারের রিক্যুইজিশন করা ভবনে ছাত্রাবাস। তিনি থাকেন আরমানিটোলায় 'বান্ধব কুটির' নামের বিরাট ছাত্রাবাসে। বান্ধব কুটিরে গিয়ে দেখেন, গেটে নোটিস ঝুলছে। সরকারের নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই রাতেই ছাত্রাবাস ছেড়ে যেতে হবে।

ঢাকা কলেজের তখন আরেকটি ছাত্রাবাস ছিল বেগমবাজারে। নাম নূরপুর ভিলা। হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের বিখ্যাত অধ্যাপক সাইদুর রহমান। ওই রাতে তার কাছে গিয়ে উঠলেন। সেখানেই কবিতাটির আরও কিছু অংশ লেখা হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। আরও একটি ঐতিহাসিক দিন। সলিমুল্লাহ হলে তখন ভাষা আন্দোলনের হেড কোয়ার্টার। সেখান থেকে নির্দেশ প্রচারিত হয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ভাষাশহীদদের জন্য গায়েবানা নামাজ হবে। ইমামতি করবেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। জানাজা শেষে বিশাল শোক শোভাযাত্রা শহর পরিভ্রমণ করবে। শোকমিছিল যখন কার্জন হলের সামনে দিয়ে অগ্রসর হয় তখন হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। গাফ্‌ফার চৌধুরী পুলিশের লাঠিতে পায়ে আঘাত পান। তাকে কয়েকজন বন্ধু কার্জন হলের ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। আহত অবস্থায় বন্ধু এবং সহপাঠী দাউদ খান মজলিস তাকে নিয়ে যান বংশালে তার আত্দীয়ের বাসায়। একদিন আহমদ হোসেন এসে হাজির। তিনি জানতে চান একুশের কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হয়েছে কি না, গাফ্‌ফার চৌধুরী বলেন, অর্ধেক লিখেছি, পুরোটা হয়নি।

আহমদ হোসেন তার হাত চেপে ধরে বলেন, আজই কবিতাটি শেষ করতে হবে। আমরা ভাষা আন্দোলন চালিয়ে রাখার জন্য একটা ইশতেহার প্রকাশ করতে যাচ্ছি। ওই ইশতেহারে কবিতাটি ছাপা হয়। এর প্রথম সুর দিয়েছিলেন সুরকার আবদুল লতিফ, পরে সুরশিল্পী আলতাফ মাহমুদ। যে সুরটি এখন প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন জহির রায়হান ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলনভিত্তিক একটি ছবি করেন, নাম 'জীবন থেকে নেয়া'। তাতে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর লেখা একুশের গানটি গ্রহণ করেন। ওই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, চীনা, জাপানি, স্পেনিশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় নানা দেশ থেকে গানটি প্রচার হচ্ছে। রাজনীতি-সচেতন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্কুলজীবনেই বাম রাজনীতিতে শামিল হন। মাতৃভাষার দাবি আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে ১৯৪৮ সালে বরিশালে কারাবন্দী হন। ১৯৫৫ সালে ভাষা-শহীদ দিবস পালন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কারাবন্দী হয়ে একমাস ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। দিয়েছেন সুযোগ্য নেতৃত্ব, জুগিয়েছেন প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুজিবনগরে অবস্থান করেন। বরিশাল হিতৈষী ও নকীব নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় শিক্ষানবিশ সাংবাদিকতার মাধ্যমে ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফে খণ্ডকালীন সাংবাদিকতার মাধ্যমে এ পেশায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তখন তিনি মেট্রিক পাস করে ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছেন কেবল। তারপর একে একে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্ব দেশের সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরি করেন। তিনি এ সময় বহু রাজনৈতিক কলাম লিখেন- প্রথমে ছদ্মনামে, পরে নিজ নামেই। আওয়াজ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন, যা ১৯৬৬ সালে ছয়দফার আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'র নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হয়েও আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী লেখাপড়ার খরচের জন্য কারও কাছে হাত পাততে চাননি। নিজের লেখাপড়ার খরচ তিনি নিজেই চালাতেন সাংবাদিকতার মাধ্যমে।

স্বাধীনতা-উত্তর দৈনিক 'জনপদ'-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' নামে একটি ছায়াছবি নির্মাণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যার পর ব্রিটেনে বাঙালিদের প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক 'বাংলার ডাক' প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। বর্তমানে বহু খ্যাতনামা দেশি-বিদেশি পত্রিকায় তিনি কলাম লিখে চলেছেন। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সেলিমা আফরোজ চৌধুরী। তার এক ছেলে ও চার মেয়ে। ১৯৭৪ সালে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং সেখানেই বসবাস করছেন। পত্নীপ্রেম ও পত্নীসেবা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর চরিত্রের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। তিনি মূলত লন্ডনপ্রবাসী হয়েছেন তার স্ত্রীর চিকিৎসার কারণেই। সাহিত্যে বাংলা একাডেমি ও ইউনেস্কো পুরস্কার, একুশে পদক, মানিক মিয়া স্মৃতি পদক, শেরেবাংলা পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক এবং লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল থেকে 'ফ্রিডম অব সিটি পদক' লাভ করেন বরেণ্য এই শিল্পী। বর্তমানে মহৎ এই ব্যক্তিত্ব আত্দজীবনী রচনা এবং দুটি ছায়াছবি নির্মাণ কাজে ব্যস্ত। বর্ণিল জীবনের প্রতিটি স্তরে বিশাল হৃদয়ের অধিকারী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। রাজনীতি-সচেতন এই লেখক তার রাজনৈতিক জীবনে কখনই অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। তিনি আজও লড়াই করে যাচ্ছেন। আজও তার কলম সোচ্চার মিথ্যার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণাত্দক প্রতিটি কলাম বর্তমান কুয়াশাচ্ছন্ন রাজনীতিতে আলোর পথ দেখাচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির বহু সংকটের সমাধান পেতে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের লেখার কোনো জুড়ি নেই। তার দীর্ঘ জীবনের কর্মময়তা থেকে আমরা যে পাথেয় পেয়েছি তা অমূল্য। ১২ ডিসেম্বর, ২০১৪ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হচ্ছে। জাতির এই গর্বিত সন্তানকে সংবর্ধনা প্রদানের মধ্য দিয়ে দেরিতে হলেও তার প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ তৈরি হলো।

লেখক : রাজনীতিবিদ

 

 

সর্বশেষ খবর