শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শরম (১৭তম পর্ব)

\'লজ্জা\' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। \'লজ্জা\' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস \'শরম\'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

শরম (১৭তম পর্ব)

অলঙ্করণ: তারেক

সবচেয়ে বেশি ক্ষমা করেনি ঢাকার ওই পাষন্ডদের। আরেকজনকে মায়া ক্ষমা করেনি, সে তসলিমা নাসরিন। লজ্জা লিখে সর্বনাশ করেছে মায়ার। বিয়ের জন্য যেই আসতো, খবর পেয়ে যেতো যে এই পরিবারের কথাই লজ্জায় লেখা। মায়াকে তো ধরে নিয়ে গিয়েছিল, মায়াকে তো ওরা ধর্ষণ করেছে। সুতরাং বিয়ে হবে না। মায়ার সঙ্গে কিছু যুবকের আলাপ হয়েছিল, তারা আগ্রহী ছিল প্রেম করতে, বিয়ে করতে, কিন্তু পিছু হটেছিল ওই কানাঘুষায় যে মেয়ের কুমারীত্ব তো নষ্ট হয়েছে। মেয়েকে মুসলমান ছেলেরা ধর্ষণ করেছে। হিন্দুরা ধর্ষণ করেছে, এটা যত না দুঃসংবাদ, তার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ মুসলমানরা ধর্ষণ করেছে। মায়ার বিয়ে হয় না। সে বুঝে যায়, বিয়ে তার হবে না। ওই লজ্জা বইটা যদি না বেরোতো, হত। মায়া চিৎকার করে কাঁদে। বাড়িতে যত লজ্জার কপি ছিল, আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় কি উন্মাদের মতো সে হয়ে যায়নি! বিদেশ বিভুইএ নতুন করে জীবন শুরু করার মতো অভিশাপ আর কী আছে! হাতে কোনও টাকা পয়সা না নিয়ে, কারও কোনও সহযোগিতা ছাড়া জীবন শুরু করা যায় না। জীবন বরং শেষ করা যায়। মায়া অনেকবার আত্দহত্যা করতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত করেনি।

সংসারে হু হু করে অভাব বাড়ে। আর মায়া ছটফট করে। মায়া শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলো তপন মণ্ডলকে। মাতাল। বেকার। কেউ কেউ বলে ছোট জাত। জাত নিয়ে কিছু যায় আসে না মায়ার। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, সে মুসলমান নয়, সে হিন্দু, এটাই সবচেয়ে বড় খবর। মায়া লুফে নিয়েছিল তপনের প্রস্তাব। বিয়ের পর ঘোমটা মাথায় শ্বশুরবাড়ি উঠেছে। শ্বশুরবাড়ির কুড়ি পঁচিশজনের জন্য রান্না করা, তাদের খাওয়ানো, তাদের ঢেঁকুর তোলানো। দুপুরে ভাত, রাতে রুটি। রাতে নিজের হাতে প্রতিদিন পঞ্চাশটা রুটি বানাতে হয়। বাড়ির কাজে তিন জার সঙ্গে ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু নিজের ভাগে পাহাড় সমান কাজ। মায়া কখনও রান্নাঘরের কাজ করেনি। জানে না সে কী করে করতে হয়। এখন শ্বশুরবাড়িতে, রান্না করতে জানি না, সংসারের কাজকর্ম করিনি আগে, বলে রেহাই পাওয়া যাবে না। মাতাল কখনও বাড়ি ফেরে, কখনও ফেরে না। তাকে আদর আহলাদ দিয়ে পোষে যাদবপুরের এক বয়স্ক মহিলা। টাকা পয়সার অভাব নেই, সেই টাকায় শুয়ে বসে খায় তপন। মহিলার স্বামী নেই, দুটো ছেলেমেয়ের বিদেশে বাস। কলকাতায় একা, সঙ্গী তপন। তপনের মতো মাতাল বেকারই তার দরকার। মদ খাওয়ালেই কুকুরছানার মতো লেজ নেড়ে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। বিয়ের পরপরই জা-দের কাছ থেকে সব জেনে গেছে মায়া। অনেক ফেরাতে চেয়েছে তপনকে। মদ ছাড়াতে চেয়েছে, মহিলা ছাড়াতে চেয়েছে, পারেনি। ছাড়াতে চেষ্টা করার সময়ই নিজের শরীর বারবার সে পেতে দিয়েছে, পেতে দেওয়া শরীরের ওপর তপন খেলাচ্ছলে যা করেছে, তাতে দুটো ছেলেমেয়ের জন্মের বীজই রোপন করা হয়েছে, সত্যিকার কাজের কাজ কিছু হয়নি। তপন ফেরেনি। বিয়ে করতে হয় বলে তাকে করতে হয়েছে। শুতে তার ভালো লাগে বলে শুয়েছে বউএর সঙ্গে। কিন্তু বউ বাচ্চার জন্য কোনও আকর্ষণ জন্মায়নি। বড় পরিবারে বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তরতর করে বড় হয়ে যেতে থাকে। বাবা করে না, বাচ্চাদের খোঁজ খবর করে ঠাকুরদা জ্যাঠামশাইরা। দায়িত্ব মায়ার। একটা ওষুধ কোম্পানিতে সে ঢুকেছিল দেড় হাজার টাকা বেতনে, সাড়ে ছ হাজার টাকা হয়েছে বেড়ে। সংসারে খাবার টাকা দিতে হয় আটশ। বাকিটা ছেলেমেয়ে এবং নিজের কাপড়চোপড়, বিস্কুট চানাচুর, বাসভাড়া মেট্রোভাড়া, ইস্কুল খরচ ইত্যাদিত চলে যায়। এক পয়সাও কখনও হাতে থাকে না। প্রয়োজনে নিজের মা দাদার কাছে যে হাত পাতবে, সে জো নেই। মায়া তারপরও শ্বশুরবাড়িতে থাকে, সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর পরে, হাতে পলা শাঁখা, লোহা। ঘরে ঠাকুর দেবতা। ভীষণ সে কালিভক্ত। সুযোগ পেলেই কালিঘাটে পুজো দেবে, সম্ভব হলে চলে যাবে দক্ষিণেশ্বর। এছাড়া তেমন তার নেই সিনেমা থিয়েটার দেখা বা গানের মেলায় যোগ দেওয়া, বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার শখ। দেশে যা শখ ছিল, বিদেশে এসে সবই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছে অথবা করতে হয়েছে। সত্যি বলতে, মায়ার কোনও বন্ধু নেই। জীবনে স্বামী নামক প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, তারপরও সিঁদুর পরে মায়া। কেন পরে! নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই সে উত্তর দিয়েছে, কারণ আর যেন তাকে সহজলভ্য মেয়ে বলে কেউ না মনে করে। ঘরে বাইরে রাস্তাঘাটে। স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ি, সিঁদুর, সন্তান-এগুলো থাকলে সম্ভ্রম থাকে। না থাকলে লোকে ছিঁড়ে খায়। মায়ার কাছে শ্বশুরবাড়ি নরক নয়, বরং বেঁচে থাকার জায়গা। স্বামী কখনও দু সপ্তাহ কখনও মাস গেলে বাড়ি ফেরে। বাড়ির কাছে কয়েকদিন ফুটপাথে মদ খেয়ে পড়ে থাকাকে টেনে বাড়ি ঢুকিয়েছে মায়া। বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে তার শাড়ি কাপড়। তারপরও মায়া ভাবেনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে স্বামী ছেড়ে সে চলে যাবে। কোথায় যাবে, তার তো জায়গা নেই কোথাও! কোথাও গিয়ে আর সে দুর্নাম কামাতে চায় না। আর ঝড়ঝঞ্ঝা চায় না। একটা দশ বাই দশ ফুট ঘরে ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, ওদেরই নিজের দুপাশে নিয়ে মায়া ঘুমোয়। বিছানাতেই খাওয়া, বিছানাতেই লেখাপড়া। বড় খাট পাতলে ঘরে আর তেমন জায়গা কই অন্য জিনিস পাতার! দুটো ছেলেমেয়ে যদি বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তবে যদি এ বাড়ি থেকে বেরোয়, মায়ের দেখাশোনা করে, মাকে শান্তি দেয়, তার ভরসায় মায়া থাকে।

কয়েক মাস পরপর সুরঞ্জনকে একটা সার্ট কিনে দেয় মায়া, কিরণময়ীকে শাড়ি। একটা নতুন সার্ট বোনের কাছ থেকে পেলে তার আনন্দ হয়, কিন্তু বোনকে সে কী দিতে পারে! কিছুই তো না। মায়া কাঁদে, অভিযোগ করে, চিৎকার করে, ক্রোধে ফেটে পড়ে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাকে ভীষণ ভালোবাসে সুরঞ্জন জানে। যে ভালোবাসে সে যতটা জানে তার চেয়েও বেশি জানে যাকে কেউ ভালোবাসে, সে।

কিরণময়ী মাঝে মাঝে যখন দেশের কথা মনে করে চোখের জল ফেলেন মায়ার সহ্য হয় না। ওই দেশের কথা উচ্চারণ করবে না একবারও। ওই দেশই আমাদের সর্বনাশ করেছে। ওই দেশ আমার জীবনের যত স্বপ্ন, যত সম্ভাবনা সব নাশ করে দিয়েছে। কিরণময়ী বরং দেশের কথা সুরঞ্জনকে বলে শান্তি পায়, ছেলে চুপ করে শোনে। বাজার থেকে একটু দেশের এটা, একটু দেশের ওটা কিনে এনে সুরঞ্জনকে রেঁধে খাওয়ায়। বেলঘরিয়ায় ভর্তি ছিল দেশের লোক। পার্ক সার্কাসে এসে অবদি কিরণময়ী কোনও দেশের লোকের সন্ধান পায় না। সবই এদেশি, ঘটি। শ কে স বলে, স কে শ বলে। উত্তর কলকাতার কিছু ছেলে সুরঞ্জনের কাছে আসে। ওদেরও ওই একই অবস্থা। বাশে চড়া যায় না, সসাংকর সাসন চলছে। কিরণময়ী মায়াকে যে দেশের সুখের স্মৃতি নিয়ে দুটো কথা বলবে, সেই সবাই মিলে সুধাময়ের বন্ধুর বাড়িতে চলে গেল পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ঘুরে এলো, মায়া তো ফিরতেই চায়নি, নৌকো করে সবার সুন্দরবন চলে যাওয়া, সেই হাসি খুশির দিন, বৃষ্টি হলেই বাড়িতে খিচুড়ি আর ইলিশ খাওয়ার ধুম, মায়ার সেই পাড়া জুড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খেলার সেইসব দিন। দিন তো ওগুলোই মনে করার, সুখ পাওয়ার। দিন কী আর কিছু আছে, যে দিন নিয়ে গোল হয়ে বসে গল্প করবে, মন ভালো হবে। কষ্টের যন্ত্রণার দিনগুলো কিরণময়ী যত পারেন স্মৃতি থেকে সরিয়ে রাখতে চান। মায়া ঠিক উল্টো, মায়া বাংলাদেশের কোনও স্মৃতিই আর মনে করতে পারে না তার ওই অপহরণ আর ভাষায় যা বর্ণনা করা যায় না তাকে ছিঁড়ে কামড়ে একপাল মুসলমানের ধর্ষণ করা। কলকাতার বৃষ্টি কিরণময়ী জানালায় বসে উদাস চোখে দেখে, মায়া নেই ভেজার, সুধাময় নেই পদ্মার ইলিশ কিনে আনার। ইলিশের মতো দামি মাছে কারও হাত দেওয়ার যো নেই। দাম কমলে হয়তো কিরণময়ী কিনে আনে ছোট দেখে ইলিশ। মায়াকে ডেকে খাওয়ায়, মায়া সেই ইলিশ এমনভাবে খায়, যেন শুক্তো খাচ্ছে। ইলিশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পদ্মার নাম, পদ্মার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম। মায়ার সয় না এতসব। মায়ের আবদারে অনুরোধে খায় বটে সে, খেয়ে কোনও সুখ পায় না। তবু ইলিশ যে খেতে পাচ্ছে, এ দেখেই সুখে চোখের জল মোছেন কিরণময়ী। সুধাময় থাকলে আজ পরিবারের এমন অবস্থা হত না। ছেলেমেয়েদের মুখে কখনও একটুখানি হাসি ফুটলে কিরণময়ী সুধাময়ের কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন। সুধাময় চলে গেছেন আজ অনেকগুলো বছর হয়ে গেল, তবু চোখের কিছু জল তাঁর জন্য তোলা আছে কিরণময়ীর। এত অভাব যায়, তিনি সামলে নেন। যুদ্ধ করার দরকার হলে করেন। একাকীত্বে ভোগেন। অনিশ্চয়তা জোঁকের মতো কামড়ে ধরে রাখে। কিছুতেই চোখের জল ফেলেন না কিরণময়ী। কিন্তু সুরঞ্জন যেদিন জড়িয়ে ধরে বলে, মা তোমাকে দেখো গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি বানিয়ে দেব। তোমাকে নিয়ে পূর্ণিমায় গঙ্গাবক্ষে নৌকো নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। বা মায়া যেদিন একটা শাড়ি এনে পরিয়ে দিয়ে বলে, কী সুন্দর লাগছে মাকে, কী সুন্দর আমার মা। তখন সুধাময়ের কথা মনে করে চোখ ভিজে ওঠে কিরণময়ীর। এই সুখের সময়গুলো তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

মাঝে মাঝে যখন খুব খাঁ খাঁ লাগে, সুরঞ্জনকে ডেকে কাছে বসিয়ে চুলে আঙুল বুলিয়ে বলেন কিরণময়ী, চল দেশে ফিরে যাই। শুনে সুরঞ্জন কিছু বলে না। নিঃশব্দে উঠে যায়। পিছনে কিরণময়ী মিহি সুরে কাঁদতে থাকেন। পার্ক সার্কাসে আসার পর থেকে মাঝে মাঝে বলছেন কিরণময়ী, যেখানে ছিলাম, সেখানেই চল চলে যাই, এখানে তো ঘর ভাড়াও বেশি। সুরঞ্জন রাজি হয় না। বলে, ওখানে বন্ধু বান্ধবরা সব শত্রু হয়ে গেছে, ওপাড়া না ছাড়লে মুশকিল হত। সুরঞ্জন মিথ্যে বলার ছেলে নয়। কিরণময়ী ছেলেকে বিশ্বাস করেন। কেন শত্রু হবে কেন? কেন শত্রু বানিয়েছিস তুই। এপাড়ায় শত্রু যদি বানাস? এরকম কি এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় দৌড়োবো তোর কারণে?

সুরঞ্জনের সঙ্গে যত সহজে তিনি মনের কথা বলতে পারেন, মায়ার সঙ্গে পারেন না। ভয়ে ভয়েই মায়াকে বলেছিলেন, তসলিমা তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে খুব।

কোন তসলিমা? তসলিমা কে? মায়া চোখ কুঁচকে তাকায় কিরণময়ীর দিকে।

তসলিমা নাসরিন।

কি চায় সে? ওই রাক্ষুসী কী চায়? আরও ক্ষতি করতে চায় আমার? যথেষ্ট হয়নি, হয়নি যথেষ্ট? ওই ডাইনির কথা কী করে জানো তুমি? কী করে জানো ডাইনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়?

কিরণময়ী মুখ খোলেন না। সুরঞ্জনের সামনে গিয়ে কোমরে অাঁচল গুঁজে দাঁড়ায় মায়া। ওই তসলিমা রাক্ষুসীটার সঙ্গে কি তোমাদের কারও কথা হয়েছে? দেখা হয়েছে?

সুরঞ্জন বইএর পাতা ওল্টাচ্ছিল। ওভাবে ওল্টাতে ওল্টাতেই বললো, হ্যাঁ দেখা হয়েছে।

কোথায়?

আমি গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে।

আর মা? মার সঙ্গে কী করে দেখা হল?

সুরঞ্জন এবার ধমকে উঠলো, এত জানার কী দরকার তোর? তুই দেখা করবি না, ব্যস, মিটে গেল।

না, মিটে গেল না। আমি চাই না তোমরা কেউ ওর সঙ্গে কোনওদিন আর কোনও রকম যোগাযোগ রাখো। যদি রাখো.. মায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

যদি রাখো .... তবে বুঝবো, আমার ওপর যা ঘটেছে বাংলাদেশে, আমার জীবনটা এই যে নষ্ট হয়ে গেল, সব .. সব তোমরা অ্যাকসেপ্ট করছো। তসলিমাকে অ্যাকসেপ্ট করা মানে আমার দুরবস্থা, আমার হিউমিলিয়েশান, দিনের পর দিন রেইপ, একটা ড্রাংক মাংকি, একটা রাস্কেল ইডিয়টের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা, আমার মৃত্যু, আমার ডেথকে অ্যাকসেপ্ট করা। আর কিছু না। মায়া মুখে অাঁচল চেপে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিরণময়ী, সুরঞ্জন।

৮.

সুরঞ্জন পুরুষ মানুষ। নিজের খেয়ালে চলে। যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ আছে তার। আজ চাকরি করলো, কাল ছেড়ে দিল। আজ কিছু করতে ইচ্ছে করছে না, করবে না। মা আছে তার নিরাপত্তায়, শাড়ি কাপড় বিক্রি করে সংসার চালিয়ে নিতে পারে। মা দেখাশোনা করে, সার্ট প্যান্টটা কাচা পায়, বালিশ বিছানা পরিস্কার পায়, ক্ষিধে লাগলে খাবার পায়, তার আর অসুবিধে কী! কিরণময়ীও এরকম ভালো আছেন। স্বামী নেই। স্বচ্ছলতা আগের চেয়ে কম। কিন্তু ছেলে তো সঙ্গে আছে। বুকের ধন তো আছে পাশে। বউ নেই। ছেলের মনোযোগ বউএর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয় না কিরণময়ীর। যখন সুদেষ্ণা ছিল, সুরঞ্জন সুদেষ্ণাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো, মার কাছে একটু বসার, মার কিসে ভালো লাগবে না লাগবে, তা খোঁজ করার সময়ও তার ছিল না। বউকে নিয়ে বেরিয়ে যেত কলেজে, ফিরতো একসঙ্গে। সন্ধেয় বাইরেও বেরোতো দুজন। কিরণময়ীর খুব একা লাগতো। ছেলের সংসার হল না তা ঠিক, বাচ্চা কাচ্চা থাকলে ঘর ভরে থাকতো আনন্দে, কিন্তু তা না থেকেই বা কী এমন খারাপ! এখন সুরঞ্জন সম্পূর্ণই তার। তার কথা ভেবেই সুরঞ্জন ঘরে ফেরে। ঘরে ঢুকেই মা মা বলে ডাকে। কিরণময়ীর মন ভরে যায়। ছেলে কখনও তাকে দুঃখ দিয়ে কথা বলেনি। অসুখ হলে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসে। জ্বর হলে সারারাত পাশে বসে থাকে। অসুখ হলেও কিরণময়ীর আনন্দ হয়। ছেলেকে আরও বেশি কাছে পাওয়া যায়। ছেলেকে কাছে পাওয়ার ভাগ্য কজনের থাকে এই বয়সে। আজকাল তো বিয়ে করে করে ছেলেরা আলাদা থাকে, বিদেশে চলে যায়, নয়তো বউ এমন আগলে রাখে যে ছেলের সাহস হয় না কাছে আসার। সুরঞ্জন হাতে করে আম আপেল, কলা কমলা মাঝে মাঝে নিয়ে আসে মার জন্য। মা এসব খাও তো। শরীর ভালো থাকবে। কিরণময়ীর ওতেই শান্তি হয়, ছেলে যে এনেছে। ছেলে যে বলেছে। নিজে সে ফলফলান্তি ছেলেকেই কেটে কেটে খাওয়ায়। টিউশনি করে সামান্য কিছু নিজের কাছে রেখে বাকিটা কিরণময়ীর হাতে দেয়, সংসার চালানোর জন্য। টাকার অংক বিরাট নয়, কিন্তু কিরণময়ীর শান্তিটা অনেক। ছেলের ভালোবাসা পেতে পেতেই যেন তার মৃত্যু হয়।

সুরঞ্জন বা কিরণময়ীকে নিয়ে নয়, আমার ভাবনা মায়াকে নিয়ে। মেয়েরা তো ভালো থাকে না। মেয়েদের তো এই সমাজটা ভালো থাকতে দেয় না। মায়া নিশ্চয়ই ভালো নেই। মায়ার জন্য ভেতর আমার রক্তাক্ত হতে থাকে। একদিন ফোনে সুরঞ্জন আর কিরণময়ী দুজনের সঙ্গেই কথা বলি। জিজ্ঞেস করি, মায়া কেমন আছে, মায়ার সঙ্গে দেখা করতে চাই। হয় মায়া সুরঞ্জনের বাড়িতে আসুক, গিয়ে দেখা করবো, নয়তো আমার বাড়ি চলে আসুক। আর তা যদি না হয়, আমি ওর শ্বশুরবাড়িতে যাবো।

[ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর