শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শতবর্ষে ওক্তাবিও পাজ

শতবর্ষে ওক্তাবিও পাজ

বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ ওক্তাবিও পাজ লোজানো (৩১ মার্চ, ১৯১৪-১৯ এপ্রিল, ১৯৯৮)। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক ও কূটনীতিবিদ। তার অসামান্য সাহিত্যকীর্তির জন্য তিনি ১৯৮১ সালে মিগুয়েল ডি সার্ভেন্তেস পুরস্কার, ১৯৮২তে নিওয়েসড্যাট ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার এবং ১৯৯০ এ সাহিত্যে নোবেল জয় করেন। পাজের জন্ম মেক্সিকোতে ওক্তাবিও পাজ সলোরজানো ও জোসেফিনা লোজানো দম্পতির ঘরে। তার পিতা তৎকালীন ডায়াজ শাসনতন্ত্রের বিরোধী বিপ্লবের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। মিক্সিকোয়াক নামক গ্রামে মা জোসেফিনা, খালা এমেলিয়া পাজ ও দাদা ইরিনিও পাজের কাছে তিনি বেড়ে ওঠেন। তার দাদা ছিলেন ঔপন্যাসিক ও প্রকাশক।

ওক্তাবিও পাজ কলিগিও উইলিয়ামস স্কুলে পড়াশোনা করেন। ছেলেবেলায় তিনি পিতামহের লাইব্রেরিতে বসে মেক্সিকান ও ইউরোপীয় সাহিত্যে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। এবং ছেলেবেলায় তার কবিতা লেখার শুরু। ১৯ বছর বয়সে তার কবিতা সংগ্রহ 'লুনা সিল্ভেস্টার' (বুনো চাঁদ) প্রকাশিত হয়। তখন তিনি কবিখ্যাতি লাভ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে পাজ তার আইনশিক্ষা ত্যাগ করে মেক্সিকোর ইউকাতানের মেরিদায় দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৭ সালে মেক্সিকান গৃহযুদ্ধ চলাকালে পাজ স্পেনে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় সংস্কৃতি রক্ষা আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে আমন্ত্রণ পান। ওই সম্মেলনে পাজ রিপাবলিকানদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেন। স্পেন থেকে দেশে ফিরে ১৯৩৮ এ 'টলার' (প্রশিক্ষণশালা) নামে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি এই সাময়িকীতে লিখেছিলেন। ১৯৩৮ এ তিনি এলোনা গ্যারোকে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ে বিচ্ছদ হয় ১৯৫৯ সালে।

১৯৪৩ সালে পাজ গাগেনহেইম নামক একটি ফেলোশিপ নিয়ে দুই বছর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে। অতঃপর তিনি মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কূটনৈতিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে কিছুদিন নিউইয়র্কে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৫ এ পাজ ফ্রান্সে বদলি হন। ফ্রান্সে বসে তিনি রচনা করেন মেক্সিকান আত্দপরিচয় ও চিন্তা নিয়ে 'এল ল্যাবিরিন্তো দে লা সোলেদাদ' (একাকিত্বের গোলকধাঁধা) নামক অনুসন্ধানমূলক নয়টি বৈপ্লবিক প্রবন্ধ।

১৯৫০ দশকের শুরুর দিকে ডেভিড রোসেট, আদ্রে ব্রিটন এবং আলবেয়ার কামু প্রমুখের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে ওক্তাবিও পাজ প্রথম বারের মতো ভারত ভ্রমণে আসেন। ওই বছরই তিনি দাপ্তরিক কাজে জাপান এবং জেনেভায় ভ্রমণ করেন। ১৯৫৪ তে তিনি মেক্সিকো সিটিতে ফিরে আসেন। ১৯৫৬ সালে পাজ লা ইহা দে রাপ্পাচিনো নামক একটি নাটক লিখেন। নাটকটির আঙ্গিক গড়ে উঠেছে অধ্যাপক রাপ্পাচিনোর মনোরম বাগানের প্রতি একজন ইতালীয় ছাত্রের ঘোরাঘুরিকে কেন্দ্র করে। নাটকে ওই ছাত্র গোপনে আধ্যাপকের অসাধারণ সুন্দরী কন্যা বিট্রেসের প্রতি গোপনে নজর রাখতেন। একসময় ওই ছাত্র বাগানের সৌন্দর্যের বিষাক্ত প্রকৃতি জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নাটকটি দারুণ সাড়া ফেলেছিল। মেক্সিকো সিটিতেই তিনি তার মহান কবিতা 'পিয়েরদা দি সল' (সূর্যপাথর) রচনা করেন ১৯৫৭ সালে। একই বছর তার কবিতা সংকলন 'লিবারতাদ বাজো প্যালাব্রা' (মুক্তির শপথ) প্রকাশ হয়।

অতঃপর ১৯৬২ সালে তিনি ভারতে মিক্সিকান রাষ্ট্রদূত নিয়োগ পান। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখনই তিনি 'In Light of India' বইটি রচনা করেন। এই বইতে নোবেল বিজয়ী কবি অক্তাবিও পাজ হিন্দু ধর্মকে একটা বর্বর কালো জাদু ও তন্ত্রমন্ত্রের ধর্ম বলে আখ্যা দেন। ব্রিটিশরা কেন তাদের দু'শ বছরের শাসনামলে সব হিন্দুকে খ্রিস্টান করতে পারল না সেই আক্ষেপও কবি অক্তাবিও পাজের 'ইন লাইট অব ইন্ডিয়া' বইতে উল্লেখ হয়েছে। পাজে এও বলেছেন মহাত্দা গান্ধী হিন্দু-ঐতিহ্য থেকে অহিংসার বোধ পাননি, বরং তিনি এই অহিংসা পরম ধর্ম এই বোধটা পেয়েছিলেন লিও টলস্টয়ের শান্তিবাদ থেকে। ভারতে থাকাকালীন ওক্তবিও পাজ 'ক্ষুধার্ত প্রজন্ম' লেখকগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। এই লেখকগোষ্ঠীর ওপর পাজের প্রভূত প্রভাব ছিল।

১৯৬৩ সালে তার ফরাসি বান্ধবী বোনার সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। একই বছর মেরি হোসে ত্রামিনিকে বিয়ে করেন। ১৯৬৮ তে ত্লাতেলোকো এর প্লাজা দি লাস ত্রেস কালতুরাস নামক চত্বরে সরকারি আদেশে প্রতিবাদী ছাত্রজনতা হত্যার প্রতিবাদে পাজ কূটনীতিবিদের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর কিছুদিন প্যারিসে বসবাস করেন। পরে মেক্সিকোয় ফিরে স্বাধীনচেতা মেক্সিকান লেখককে সঙ্গে নিয়ে প্লুরাল (১৯৭০-১৯৭৫) নামক ম্যাগাজিন বের করেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস এলিয়ট নর্টন অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা (১৯৭০-১৯৭৪) করেন। ১৯৭৭ এ পাজ সাহিত্যে জেরুজালেম পুরস্কার লাভ করেন। ওক্তাবিও পাজের রচনা পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার কবিতার প্রধান উপজীব্য ছিল ভালোবাসা ও কাম, সময়ের প্রকৃতি ও বৌদ্ধিক দর্শন। আধুনিক চিত্রকলার প্রতি পাজের অনুরাগ ছিল, যা নিয়ে তার কিছু কবিতা রয়েছে। একজন প্রবন্ধকার হিসেবে পাজ মেক্সিকান রাজনীতি ও অর্থনীতি, আজটেক শিল্প, নৃবিজ্ঞান ও যৌনতা বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তার সুদীর্ঘ প্রবন্ধসংগ্রহ 'একাকীত্বের গোলকধাঁধা'তে তিনি তার দেশের জনগণের মনের গভীরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তার অন্যান্য সৃষ্টিকর্মগুলো হলো, 'এগুলিয়া ও সোল' (১৯৫১), 'লা এস্তাসিয়োন বিওলেন্তা' (১৯৫৬), 'পিয়েদ্রা দে সল' (১৯৫৭)। ইংরেজি ভাষায় অনূদিত তার কবিতা সংকলনগুলো হলো 'আর্লি পোয়েমস' (১৯৭৪) এবং 'কালক্টেড পোয়েমস' (১৯৮৭)।

১৯৮০ তে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পাজকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন। ১৯৮২ তে লাভ করেন নিউতস্তাদত পুরস্কার।

ওক্তাবিও পাজ প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট পার্টি করলেও ১৯৭৪ সালে তিনি কমিউনিজম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। কম্যুনিজমের মিথ্যাচার ও গণহত্যার হিসাব কষে পাজ সোশ্যাল ডেমোক্রেসিকেই তার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন। বামপন্থায় বিশ্বাস ছিল পাপ এই পাপ আমাদের কলঙ্কের দাগ দিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পাজ ও তার 'বুলেতা' ম্যাগাজিনের সহকর্মীরা কমিউনিজমের পতনের ওপর আলোচনার জন্য পৃথিবীর নানা দেশের লেখকদের মেক্সিকো সিটিতে আমন্ত্রণ জানান। ওই সম্মেলন ২৭ আগষ্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেক্সিকোর টেলিভিশনে সম্প্রচার হয়। বিশ শতকের মহান লেখক ওক্তবিও পাজ ১৯৯৮ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

 

সর্বশেষ খবর