শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

শরম (২২তম পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (২২তম পর্ব)

'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

শোভনবাবু থেকে শোভন। শোভন থেকে সোবহান। এভাবে একটু একটু করে তাকে চিনেছে সুরঞ্জন। যেদিন সে জানলো যে সে আসলে সোবহান, চমকালো। তার চমকে ওঠা মুখের সামনে সোবহানের মাথা নত, বিষণ্ন মুখ।

আপনি হিন্দু না?

সুরঞ্জনের প্রশ্নের জবাবে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শুধু না বোধক মাথা নাড়লো।

ও শিট। সুরঞ্জনের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো রাগের বিরক্তির অপমানের একটা শব্দ।

সোবহান দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে।

সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কথা বলা। মাথা নিচু করে থাকা ভালো স্বভাবের ছেলে সোবহান। সুরঞ্জনের তাকে না হলেও চলে। সোবহানেরও চলে। চলে কিন্তু চলে না। দুজন কী ভীষণরকম একা। এবং দুজনই দুজনের শ্রোতা। সুরঞ্জন তার বাবার মায়ের বোনের স্ত্রীর গল্প বলে। সোবহানের কাছে সব গল্পই করেছে, এমনকী তার মুসলমান বিদ্বেষী বন্ধুদের, কিন্তু কখনও জুলেখার কথা সে বলেনি সোবহানকে। কেন সোবহানকে বলতে তার বাধে, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে উত্তর যেটা পেয়েছে, সেটা হল সোবহান মাথা নিচু করে থাকা ছেলে, আর সুরঞ্জন মাথা উঁচু করে থাকা ছেলে। সুরঞ্জন মেজরিটি। সোবহান মাইনরিটি। জুলেখার সঙ্গে সুরঞ্জনের সম্পর্কের কথা জানা মানে সুরঞ্জনও সোবহানের কাতারে দাঁড়ালো এসে। মাইনরিটির সঙ্গে বন্ধুত্ব আর মাইনরিটির সঙ্গে প্রেম দুটো দু জিনিস। প্রেম মানে শুধু প্রেম নয়, অনেক কিছু। প্রেমের পরে বিয়ে, বিয়ের পরে সন্তান। যে সন্তানটি পিওর হিন্দু সন্তান নয়। মুসলমানের গর্ভের সন্তান মুসলমানই।

শোভনবাবুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুসলমান সোবহানকে আবিষ্কার করার পর সম্পর্ক আর রইলো না। শোভন আর সুরঞ্জন দুজনই জানতো সম্পর্কটা আর এগোবে না। ওই আবিষ্কারের ঘটনার পর আর কোনও দেখা সাক্ষাৎ নেই। কোনও খোঁজ খবর নেই। জীবন যার যার তার তার। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এভাবেই চলছিল। চলেও যেত এভাবেই। কিন্তু সুরঞ্জনই, সে নিজেই জানে না কী কারণে যোগাযোগ করলো প্রথম। সোবহানকে ছাড়া তার চলবে না। চালালেই চলতো। কিন্তু সুরঞ্জন আলসেমি করে চালালো না। সে একটা ঝুঁকি নিল। নিতান্তই হেঁয়ালির মতো একটা ঝুঁকি। যাদের সে জানে যে রক্তের মধ্যে বদমাইশি আর বিশ্বাসঘাতকতার বীজ, তাদের সঙ্গেই সে মেলামেশা শুরু করলো। নন্দননগর ঝিলের ধারে, রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠে, কমপিউটারের দোকানে সুরঞ্জনই সোবহানের সঙ্গে তখন অনর্থক গল্প করে কাটায়। মনে মেলে বলেই সম্ভবত। তাছাড়া আর কী! বন্ধুর তো তার আর অভাব ছিল না। সুরঞ্জনের তো অবশ্যই ভালো লাগে। সোবহানের কেমন লাগে তা সে কোনওদিনই সে বলেনি, প্রসঙ্গ এলে মুখে রহস্যময় একটা হাসি ফুটে ওঠে শুধু।

সুরঞ্জনের সঙ্গে সোবহানের মাখামাখিটা বেলঘরিয়ার বন্ধুদের পছন্দ হয়নি। সোবহানের ওপর যেদিন চড়াও হয় ওরা, সেদিন সুরঞ্জনের মাথা ঠিক ছিল না। সোবহানের কমপিউটারের দোকানে বসেছিল সে। অচিন্ত্য ঢুকে বললো, কী রে মুসলমানের সঙ্গে ভাব হচ্ছে নাকি বেশ? তা মালটা কোথায়?

সুরঞ্জন ঠাণ্ডা গলায় বললো, বাজে কথা বলিস না।

কিছু টাকা ফেলতে বল।

মানে?

মালটা তো হিন্দুদের দেশে বসে ভালো কামাচ্ছে। তা হাজার দশ ফেলতে বল আজ। নইলে..

নইলে কী?

নইলে রাজারহাটে নিয়ে গিয়ে কপালে একটা চুমু খাবো আদর করে। অচিন্ত্যের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

সুরঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। তার কথা বলতে ঘেন্না হয়। অচিন্ত্য এর দিন দশেক পর তার আরও কয়েকটা শিষ্য নিয়ে সকালবেলা সোবহানের ওপর চড়াও হয়। অচিন্ত্য ভেতরে ঢুকলো। শিষ্যরা অবস্থান নিল দোকানের দরজায়।

চাঁদা দিন সোবহান সাব।

কিসের চাঁদা?

পুজোর।

কী পুজো।

কার্তিক পুজো।

কার্তিক পুজো?

হ্যাঁ পাঁচ হাজার এক টাকা দিয়ে দিন। পুজোটা করে ফেলি।

সোবহান অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। পরে বললো, দুর্গা পুজো, কালি পুজো, সরস্বতী পুজোয় আমি চাঁদা দিই। কার্তিক পুজোয় তো দাদা আমি পারবো না।

অচিন্ত্য হেসে বললো, আপনাকে তো দিতেই হবে চাঁদাটা।

অত টাকা আমার কাছে নেই।

নেই বললেই তো হবে না।

তাহলে?

টাকাটা এখন, এই মুহূর্তে যে লাগবেই মিস্টার সোবহান।

সোবহান ঢোক গিলছে। মাথা নিচু।

এবার জোরে একটা ঘুষি সোবহানের সামনে টেবিলের ওপর পড়লো। গ্লাস ভর্তি জল ছিল, ছিটকে পড়লো।

এক হাজার দিলে চলবে?

এক হাজার দিলে তো পুজোটাই হবে না।

এই মুহূর্তে..

অচিন্ত্য সোবহানের শার্টের কলার মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে দেয়ালে চেপে ধরলো। সোবহান তার সহকারিকে কাছাকাছি কোনও একটি দোকান থেকে এক্ষুণি চার হাজার টাকা ধার আনার জন্য বললো। সহকারি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। কলার ছেড়ে অচিন্ত্য বসলো একটা চেয়ারে, সুরঞ্জনের মুখোমুখি। না সুরঞ্জন কোনও কথা বলেনি। তাকিয়েছিল বাইরে রাস্তার মানুষের দিকে, তাদের হেঁটে যাওয়া, সাইকেলে যাওয়া, যান বাহনে যাওয়ার দিকে। কেউ উত্তরে যায়, কেউ দক্ষিণে। সহকারি খুব দেরি করেনি। ঘেমে নেয়ে টাকাটা সোবহানের হাতে দিল। পকেট থেকে একহাজার এক টাকা বের করে ধারের চার হাজার মিলিয়ে অচিন্ত্যকে দিল। টাকাটা গুনে পকেটে ভরে, সোবহানের পেটে একটা শক্ত লাথি কষিয়ে শালা মুসলমানের বাচ্চা বলে মেঝেয় থুতু ফেলে চলে গেল। সুরঞ্জন পাথরের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে বেরিযে যায়। সোবহানের সঙ্গে কোনও কথা সে বলেনি। বেরিয়ে রাস্তায় সে অচিন্ত্যকে ধরে। পেছন থেকে পা পেচিয়ে টেনে ফেলে দেয় অচিন্ত্যকে। টাকাটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। বলে, গুণ্ডামি করিস কার সাথে?

লাফ দিয়ে উঠে সুরঞ্জনের চোয়ালে ঘুসি দিয়ে বলে, মুসলমানের সাথে।

সুরঞ্জন পাল্টা ঘুসি দিয়ে বলে, না, তুই গুণ্ডামি আজকে আমার সাথে করেছিস।

অচিন্ত্য গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, সুরঞ্জন, সাবধান, টাচ করবি না। তোর সাথে কিছু করিনি আমি। চাঁদা চাইতে গেছি, সে যদি তোর বন্ধু হয়, ইটস ইওর প্রবলেম, নট মাইন।

সুরঞ্জন বলে, তুই পুজোর চাঁদা নিবি, নে, হিন্দুদের কাছ থেকে নে। মুসলমানকে প্রেশার দিবি কেন শুনি? ওদের ঈদের সময় তোর কাছ থেকে চাঁদা নেয়? কত টাকা চাঁদা দিয়েছিস এ পর্যন্ত? অচিন্ত্য জোরে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে, এখনও ওদের সঙ্গ ছাড় সুরঞ্জন। তোর কি জানা হয়নি ওরা কী জিনিস? বাংলাদেশে ভুগে আসিসনি? ওরা ফেরোসাস। ওদের বিষদাঁত তোর এখনও দেখা হয়নি। যত ক্রাইম হয় দেশে, কারা করে জানিস না? চোখ বুজে থাকিস? ওরা এ দেশে থাকে, একটা কাপল বারো চৌদ্দটা করে বাচ্চা বানায়, দেশটায় কী হারে বাড়ছে মুসলমান দেখছিস না? ওরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, বোমা মেরে মেরে আমাদের সবাইকে মারবে। দেশটা দখল করে নেবে। দেখিস তুই। ওরা পাকিস্তানে চলে যায় না কেন? পাকিস্তান খেলায় জিতলে তোর ওই বন্ধু যায় না পাকিস্তানের পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে? যায়। আমাদের দেশে থেকে আমাদের ট্যাঙ্ না দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। যা, দেখ গিয়ে পাকিস্তানে তলে তলে বাড়িও বানাচ্ছে বোধহয়। সব টেররিস্টের জাত। ইচ্ছে করে লাশ ফেলে দিই শালাদের। অচিন্ত্য বলছে আর হাঁপাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে আর ঘামছে। ঘামছে। তার চোখ ফেটে আগুন আর জল দুইই বেরোচ্ছে। ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। তার মনে পড়তে থাকে অন্যকিছু। মনে পড়তে থাকে ঠিক এরকমই সব কথা। এমন কথা আগেও সে শুনেছে, শুনেছে বাংলাদেশে। হিন্দুবিরোধী কট্টরপন্থী মুসলমানেরা বলতো এভাবে, ওরা ভারতে চলে যায় না কেন? ভারত খেলায় জিতলে ওরা খুশি হয় মনে মনে। আমাদের দেশে থেকে আমাদের ট্যাঙ্ না দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। দেখ গিয়ে ভারতে তলে তলে বাড়িও বানাচ্ছে বোধহয়।

অচিন্ত্য একসময় নকশালপন্থী ছিল। এখন কোনও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নয়। কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, বজরং দলের কিছু ছেলের সঙ্গে কিছুদিন ঘুরেছিল। এরপর সিপিএমএর খাতায় নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু ওখান থেকে কারও জানা নেই কেন নাম কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অচিন্ত্য নিজের বিশ্বাসে নিজে চলে। কাউকে পরোয়া করে না। বিজেপির লোকদের সে গালি দিয়ে বলে, তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। অচিন্ত্যর গুণগ্রাহী কম নয়। সাধারণের মধ্যে তো আছেই, এমনকী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকেরাও অচিন্ত্যর শিষ্য হয়েছে স্বেচ্ছায়।

এই অচিন্ত্যর সঙ্গে, অচিন্ত্যই বলে দিয়েছে, যে, তেড়িবেড়ি করলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। সুরঞ্জন আর একটি কথা না বলে ফিরেছিল নিজের বাড়ি। আর বাড়ি থেকে সে বেরোয়নি। তার কেবল মনে পড়েছে অচিন্ত্যর কথাগুলো। কী বীভৎস ঘৃণা উপচে উঠছে। মুসলমান জাতটার প্রতি ঘৃণা। একই রকম হিন্দু ঘৃণা সে দেখেছে। হিন্দু মুসলমানে অমিল অনেক, কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের একটিই মিল, সে ঘৃণার মিল। কিন্তু সবাই তো নয়। সবাই কি? বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সুরঞ্জন। সুরঞ্জন কি? বারবার সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, সুরঞ্জন কি? সুরঞ্জন কি? আমি কি? আমি কি? ঘামতে থাকে সে। একবার উঠে জল খায়। আবার শোয়। এপাশ ওপাশ করে। ওঠে। পায়চারি করে। সিগারেট ধরায়। একটা শেষ হলে আরেকটা। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। চপ্পল পরে বেরিয়ে পড়ে, কোথাও না, এদিক ওদিক হেঁটে ফিরে আসে। বই মেলে ধরে চোখের সামনে। বন্ধ করে। উঠে চা করে। চা ঠাণ্ডা হতে থাকে। সিগারেট ধরায়। শোয় চিৎ হয়ে। আবার উপুড় হয়ে। বালিশ একটা বুকে চাপে। বুকে চাপা বালিশটায় আবার মুখ গুঁজে দেয়। একটা ঘুমের বড়ি খোঁজে বাড়িতে। পায় না। দরজা ভিজিয়ে রেখে বেরোয়। ফার্মেসিতে যায়। ঘুমের ওষুধ পাওয়া যাবে কি না জানতে চায়। যাবে না। ফিরে আসে। সিগারেট ধরায়। দ্রুত শ্বাস পড়তে থাকে তার। বুকে ব্যথা ব্যথা লাগে। স্নান করে। স্নান থেকে এসে সিগারেট ধরায়। পায়চারি করে। আবার চা করে খায়। ফোন বাজে। ফোন ধরে না। কিরণময়ী কথা বলতে আসে। বলে দেয়, বিরক্ত না করতে। শুয়ে পড়ে, এবার উপুড় হয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। সুরঞ্জন ওভাবেই শুয়ে থাকে। [ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর