শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

জাতীয়তাবাদের সীমা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জাতীয়তাবাদের সীমা

'জাতীয়তাবাদের সীমা' শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো ২০তম পর্ব-

শেষ রাতে সে গ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, আমিনার হাত ধরে। যাবে চটকলে, শ্রমিক হবে, যে যাওয়াতে তার ভেতরে রয়েছে গভীর শঙ্কা ও আপত্তি।

গফুরের এই গল্প শরৎচন্দ্র ওই একটিই লিখেছেন, দ্বিতীয় কোনো কাহিনী তার পক্ষেও লেখা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এ গল্পের বিষয়বস্তু যদিও গফুর জোলার বাস্তুচ্যুতি, কিন্তু গল্পের শিরোনামে গফুর আসেনি, এসেছে দেবতার নামে যার নাম সেই মহেশ। গফুরের চেয়ে মহেশ বড় হয়ে উঠেছে। এটা কি স্বাভাবিক ঘটনা? হ্যাঁ, সমাজ বাস্তবতায় সেটিই ছিল স্বাভাবিক। এই বাস্তবতাটিকে বদলাবার প্রয়োজন ছিল; কিন্তু শরৎচন্দ্র তাতে উৎসাহী ছিলেন না। তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, সমাজতন্ত্রী নন।

যে জমিদার গফুরের বাস্তুচ্যুতি ও মহেশের মৃত্যুর জন্য দায়ী সে পাপিষ্ঠ একজন ছোট ও খারাপ জমিদার; ভালো জমিদার অনেক ছিল, এমন কি আদর্শ জমিদারও পাওয়া যেত- যার সন্ধান শরৎচন্দ্র দিয়েছেন, বিশেষভাবেই দিয়েছেন তার শেষ উপন্যাস বিপ্রদাস-এ। পূর্বসূরি বঙ্কিমচন্দ্র জমিদারি প্রথার অবসান চাননি, উত্তরসূরি শরৎচন্দ্রও যে চেয়েছেন তা নয়।

শরৎচন্দ্রের জাতীয়তাবাদে সাম্প্রদায়িকতার জন্য কোনো জায়গা থাকার কথা ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি হিন্দু-মুসলিম বিরোধের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন, সামাজিকভাবে মুসলিম সমাজের প্রতি তার কোনো প্রকার বিদ্বেষ ছিল না, বরঞ্চ সেই সমাজের মেধাবান সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার ছিল অবাধ মেলামেশা; কিন্তু শ্রেণীস্বার্থ শাসিত রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহ তাকেও যে স্পর্শ করেনি এমনটা বলা যাবে না। আমরা তো দেখলামই যে রাজনৈতিকভাবে তিনি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের পক্ষে, অর্থাৎ কৃষকের বিপক্ষে, অবস্থান না-নিয়ে পারেননি। আর ওই অবস্থান সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, অপরিহার্যভাবেই। শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা অধিকাংশই ছিল উচ্চ বর্ণের হিন্দু। পথের দাবি সাক্ষী, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা শ্রেণীগত বাধা না-থাকার কারণে শিক্ষিত দেশীয় খ্রিস্টানদের পর্যন্ত দলে নিতে সম্মত ছিল, কিন্তু মুসলমানদের নয়। সহিংসাপন্থি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের দলে মুসলমান যুবকদের স্থানসংকুলান সম্ভব হয়নি। অনেকের ধারণা কবি শশীর ভেতর কবি নজরুল ইসলাম আছেন; কিন্তু মুসলমান নামে তিনি সেখানে উপস্থিত হবেন এমনটা সম্ভব ছিল না, নাম বদলে তবেই প্রবেশাধিকার পেয়েছেন।

ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক অধিপত্য যে শরৎচন্দ্রের মতো অসামান্য মেধাবান মানুষকেও ছাড় দেয়নি তার প্রমাণ তার ব্যক্তিগত উক্তিতেও পেয়ে যাই। আমরা জানি যে, খাদ্য বিষয়ে বাছবিচারে ব্রাহ্মণরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল। সে সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গিও অব্রাহ্মণসুলভ নয়। একটি চিঠিতে আছে,

'দিদি, আমি কোনো কালে খাওয়া ছোঁয়ার বাছবিচার করিনে, কিন্তু ব্রাহ্ম মেয়েদের হাতে আমি কোনো দিন কিছু খাইনে। শুধু খাই তাদের হাতে যাদের বাবা মা দু'জনেই ব্রাহ্মণ এবং বিয়েও হয়েছে ব্রাহ্মণের সঙ্গে।'

এ চিঠি তিনি লিখেছেন ১৯১৭ সালে, রুশ দেশে যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটছে, লেনিনের নেতৃত্বে। ওই বছরেই প্রকাশিত শ্রীকান্তের প্রথম খণ্ডের একেবারে শুরুতেই শ্রীকান্তের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আছে, যেটি সে করেছিল স্কুলের খেলার মাঠে ফুটবল খেলোয়াড়দের ভেতর মারামারির ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে। উক্তিটি এই রকমের, 'ইস্কুলের খেলার মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ চলিতেছিল।' এ বক্তব্য পরে যে সংশোধন করা হয়েছে এমন নয়। বাঙালিরা মুসলমান নয় এবং মুসলমানরা বাঙালি হতে পারে না, এই রকমের চরম ধরনের বক্তব্য হিন্দু মহাসভাপন্থিরা করতে পছন্দ করত এবং এর পেছনে প্রোথিত যে মনোভাব সেটি যে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িকতার অন্ধগলিতে প্রবেশ করতে উৎসাহ জুগিয়েছে সেটা তো আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে পরিষ্কারভাবেই লিখিত আছে।

শরৎচন্দ্রের রচনাবলী পাঠ করলে দেখা যাবে যে মাঝে মধ্যে নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য যে তিনি প্রকাশ করেননি এমন নয়। যেমন এক জায়গায় বলছেন, 'প্রত্যেক হিন্দুই মনেপ্রাণে ন্যাশনালিস্ট। ধর্মবিশ্বাসে তারা কারও হতে ছোট নয়।' পথের দাবি যে বছর লেখা হয় সেই ১৯২৬ সালে দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদীরা কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয় এবং ঠিক তার আগের বছরেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে উদ্যোগী রাজনৈতিক নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ পরলোকগমন করেন। পথের দাবি প্রকাশের কয়েক মাস আগে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, মুক্তি অর্জনের ব্রতে হিন্দু যখন আপনাকে প্রস্তুত করিতে পারিবে, তখন লক্ষ্য করিবার প্রয়োজন হইবে না, গোটাকতক মুসলমান ইহাতে যোগ দিল কি না। ভারতের মুক্তিতে মুসলমান সমাজেরও মুক্তি মিলিতে পারে, এ সত্য তাহারা কোনোদিনই অকপটে বিশ্বাস করিতে পারিবে না। পারিবে শুধু তখন যখন ধর্মের প্রতি মোহ তাহাদের কমিবে।

'আমরা' ও 'তাহারা'র যে স্বতন্ত্র বৃত্ত তখন তৈরি হয়েছিল শরৎচন্দ্র তার বাইরে থাকতে পারেননি। ধরা পড়েছিলেন। মুসলমানরা ধর্মের মোহে আবিষ্ট আর হিন্দুরা তা থেকে মুক্ত এই বোধ তখন কংগ্রেসের রাজনীতিতে বিদ্যমান। কিন্তু আসল ঘটনাটা তো তেমন ছিল না। ধর্মের মোহে উভয় সম্প্রদায়ই আক্রান্ত ছিল। শরৎচন্দ্র হিন্দু মুসলমানের রাজনৈতিক বিভাজনে সায় দিচ্ছেন। খেয়াল করছেন না যে, যে ধরনের মুক্তির কথা তিনি বলছেন সেটা আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার অতিরিক্ত কিছু নয়। হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সমস্যার দিকে অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োগ করলে বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, ওই স্বাধীনতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এবং এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যাওয়ার কথা ছিল হিন্দুদের হাতে। প্রয়োগ করলে তিনি বুঝতেন যে, হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের কারণে সংখ্যালঘু মুসলমানরা সুবিচার পাবে না, এই আশঙ্কায় তাড়িত হয়ে মুসলমানরা কেবল স্বাধীনতা চায়নি, স্বাধীনতায় নিজেদের অংশপ্রাপ্তির বিষয়েও নিশ্চিত হতে চেয়েছে। ব্যাপারটাকে এমন কি শরৎচন্দ্রের পক্ষেও যে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি এই দুঃখজনক ঘটনা প্রমাণ করে যে, সাম্প্রদায়িকতা তখনকার জাতীয়তাবাদের কতটা গভীরে চলে গিয়েছিল। প্রমাণ আরও আছে এবং তা পাওয়া যাবে শরৎচন্দ্রেরই অপর একটি উক্তিতে, যেটি তিনি করেছিলেন ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারাকে সামনে রেখে। মুসলমানদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, এত বড় যে অন্যায় আমাদের- হিন্দুদের উপর হলো- এ তারা জেনেও নীরব রইলেন- এটাই সবার চেয়ে দুঃখের কথা। [ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর