মঙ্গলবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

রবিউল হুসাইন

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফসল হচ্ছে বাংলা একাডেমি। পাকিস্তানি বর্বর শাসকরা পূর্ববাংলার প্রতি প্রথম থেকেই হিংসাত্দক কার্যকলাপের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রমূলক নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল, অথচ বাঙালিদের শতকরা ৬০ ভাগ ভোট পেয়েই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। এমন অকৃতজ্ঞ মানুষ পাকিস্তানিরা যে, পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অবধি দেখা পাওয়া ভার। বিশেষ ধর্মের নামে দ্বিজাতিতত্ত্বের অমানবিক বাড়াবাড়ি ও গণতন্ত্রের গূঢ়মূল কথা-সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত- এসবকে জলাঞ্জলি দিয়ে একনায়কতন্ত্রসুলভ যখন যা ইচ্ছা তা-ই জন ও গণবিরোধী ক্রমাগত অত্যাচার, অবিচার এবং নিষ্পেষণমূলক ব্যবস্থা জোর করে বাস্তবায়ন করাই তাদের জঘন্য কর্ম ছিল। এসব আরও ঘনীভূত হয় যখন পাকিস্তানি সেনাশাসন নিষ্ঠুরভাবে প্রচলিত হয় অর্থাৎ এই পূর্ববাংলার অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য- পরম্পরাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সেই অপশাসনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। তা না হলে তথাকথিত উদার গণতন্ত্রপন্থি জিন্নাহ কেমন করে উচ্চারণ করেন এমন একটি একশ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ভূখণ্ডে যে, উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! ছাত্র-জনতা তাই ইংরেজি 'না' শব্দের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার সেই জনসভায় করেছিল এবং সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বীজের প্রথম অঙ্কুরোদ্গম। তারপর প্রবল গণআন্দোলনে ভাষার জন্য ছাত্ররা পুলিশের গুলিতে প্রাণ উৎসর্গ করল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেল। এখন সেই একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ভাষা দিবস তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে এই দিনটি পৃথিবীতে অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেখানে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম ভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণদান করেছিলেন সেই জায়গায় মাথা উঁচু করে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন যার ইঙ্গিতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল আন্দোলনরত নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রদের প্রতি, তার সেই সরকারি বাসভবনটিই হলো বাংলা একাডেমির নিজস্ব ভবন। বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে যাবতীয় কার্যপরিধি যেমন- গবেষণা, অনুবাদ, লোকজসাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা, প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক চর্চা- সব কিছু এই ভবনটিকে ঘিরে বাস্তবায়িত হতে থাকবে এবং সেই সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি, সেটা হলো ভাষা দিবস উপলক্ষে মাসব্যাপী বইমেলা। 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' নামে এ মেলাটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, লোকজ ঐতিহ্য- যাবতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানচর্চা এবং সেসবের প্রকাশনা, বিপণন, প্রচার, প্রসার ও সংরক্ষণই এ বইমেলা দ্বারা সংগঠিত হয়ে আসছে। এভাবেই বাঙালিরা প্রতিবছর নিজের কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসে নিঃসঙ্কোচে।

১৯৬২ সালে ঢাকায় প্রথম আগমন। তখন বইমেলার প্রচলন ছিল না, বা বলা যায় এখনকার মতো এত জনসমাগমে শোক জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। খুব ভোরে খালি পায়ে আজিমপুর গোরস্থানে ভাষা-শহদীদের কবর প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে যাওয়া হতো। মুখে মুখে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর একুশের গান, হাজারবার শুনলেও যেটার সুর আলতাফ মাহমুদের, কখনো আশ মেটে না। শহীদ মিনারে গিয়ে সেখানে ফুলে দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে আসা হতো। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় দেখা যেত। তবে অবশ্যই এখনকার মতো নয়। শহীদ মিনার ঘিরে ভূগর্ভস্থ একটা অর্ধবৃত্তাকার কক্ষ ছিল পেছন দিকে। খোলা থাকলে তার ভেতরে ঢুকে নিচে নেমে দেয়ালের দুপাশে শিল্পী হামিদুর রাহমানের রঙিন জ্যামিতিক গড়নে ভাষা-আন্দোলনভিত্তিক ম্যুরাল বা দেয়ালচিত্র দেখা হতো। এভাবেই ভাষা দিবসটি প্রায় সবাই পালন করত কিন্তু বইমেলা যেমন এখন বর্ধমান ভবন ঘিরে হয় প্রবল জনসমাগম ও তাদের সম্মিলিত উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তেমন দেখা যেত না কিংবা ওই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তেমন যাওয়া হতো না। শহীদ মিনারের মূল নকশা শিল্পী হামিদুর রাহমানের, তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক আঙ্গিক ও মননের ভাস্কর নভেরা আহমেদ। সেই সময়ে তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন সরকারের অধীনে কর্মরত ডেনমার্কের স্থপতি জা দেঁলোয়া যিনি শিল্পী হামিদুর রাহমানের মূল নকশাটিকে স্থাপত্যের মাপজোকে বাস্তবায়িত করেছিলেন এবং তখন যেভাবে নির্মিত হয়েছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ মূল নকশায় দেখানো ফাঁসি কাষ্ঠের দুটো স্তম্ভের মতো, ভেতরে জেলখানার লোহার গরাদের মতো খাড়া বা ঘোমটা মাথায় মা, একজন দুঃখী অসহায়া মাঝে বসে, তার দুদিকে দুটি সন্তান- এরকম প্রতীক ছাড়াও মাঝে রঙিন কাচ বসানোর পরিকল্পনা ছিল, যাতে সকালের রোদ ক্রমাগত সময়ের সঙ্গে প্রতিফলিত ও পরিবর্তিত হয়ে মেঝের বা মঞ্চের ওপর পড়ে বিমূর্ত নানা ধরনের নকশা সৃষ্টি করতে সহায়ক হয়। এ ছাড়া ভাস্কর নভেরা আহমেদের নকশায় মঞ্চের দুই পাশে বাংলা বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর বারান্দার রেলিংয়ের মতো স্থাপতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেসবের কিছুই পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তী সময়ে বর্বর পাকিস্তানি জল্লাদরা '৭১ সালে এ মিনারটিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় এবং সেখানে মসজিদ লিখে তাদের হীন ইচ্ছা নগ্নভাবে প্রকাশ করে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সময়ে পুরনো শহীদ মিনারের খণ্ডাংশ রেখে নতুন করে শহীদ মিনার স্থাপন করার একটি উন্মুক্ত স্থাপত্য প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয় বাংলাদেশ স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায়। প্রায় বিশটি নকশা মডেল ড্রইংসহ বঙ্গভবনে জমা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, স্থপতি মাজাহারুল ইসলামসহ অনেকে এই বাছাইয়ের বিচারক ছিলেন।

এ সময় জয়নুল আবেদিন সেই বিচার সভায় আপত্তি তোলেন এই কারণ দেখিয়ে যে, শহীদ মিনার যেটি পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে সেটিকেই হুবহু পুনর্গঠন করা দরকার, যেহেতু সেটি বাংলা ভাষার প্রতীক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের অনন্যতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে আপামর বাংলা ভাষাভাষী জনগণের কাছে। শেষ পর্যন্ত নতুন নকশা করার উদ্যমে ছেদ পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে বর্তমান রূপ পায়, যদিও মূল পরিকল্পনায় মিনারের স্তম্ভগুলো স্টেনলেস স্টিলের হওয়ার কথা। এই সঙ্গে সমগ্র চত্বর সম্প্রসারিত হয়ে সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা অবধি গিয়ে দক্ষিণে পেঁৗছবে। আর বর্ধমান ভবন যেটি মহাপরিচালক মনজুরে মাওলার সময়ে নতুন আঙ্গিকে মূল নকশানুসারে তিনতলা পর্যন্ত করা হয় পুনর্গঠিত রূপে, সেটিরও মহাপরিকল্পনায় দালানের উত্তর দিকে তিন তলা বরাবর বিশাল দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পোড়ামাটির কাজ করার কথা এবং সেই সঙ্গে প্রতি তলার বাইরের দিকে ছাদ বরাবরেও, কিন্তু সেসব আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি যদিও পোড়ামাটির নকশা আমাদের বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি-সভ্যতার অন্যতম প্রধান বাহন ও মাধ্যম। বইমেলা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাগুক্ত সম্পৃক্ত বিষয়াবলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হলো, যেহেতু ওগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। বইমেলার কথা মনে এলে প্রথমেই মনে হয় মুক্তধারা প্রকাশনা সংস্থার বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার কথা। তার মতো নিরলস ও ঐকান্তিক এক ভবিষ্যদ্-দ্রষ্টার কারণেই আজ এই গ্রন্থমেলা বিশাল মহীরুহে রূপান্তরিত হয়েছে। মনে পড়ে কী দীনহীন অবস্থায় কারও দিকে দৃকপাত না করে চিত্তবাবু নিজের মহান উদ্দেশ্য সফল করার জন্য চাদর বিছিয়ে মাঠের মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসে মুক্তধারা প্রকাশিত কতকগুলো বই বিছিয়ে মেলার শুভারম্ভ করেন। তার দেখাদেখি অন্য স্বনামধন্য প্রকাশকরা একে একে বই নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে বাংলা একাডেমির সমগ্র চত্বরজুড়ে সেটি বিশাল এবং অনন্য একটি প্রধান বইমেলায় পর্যবসিত হয়। এই মেলায় নিজের স্মৃতির কথা মনে হলে মনে পড়ে পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের মিলনমেলার অপরূপ ঘটনায় নিজেকে মেলে ধরার। এখানে এলে নিজেকে পাখির মতো ভারমুক্ত, স্বাধীন এবং অপরাজেয় বলে মনে হয়। প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক, প্রিয় কবি, প্রিয় প্রকাশকদের দেখা পেয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই। মনে পড়ে জনপ্রিয় কবি লেখকদের সামনে মুগ্ধ পাঠক-পাঠিকাদের কী নিষ্পাপ আকুতি ও উচ্ছ্বাস। আর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মনে পড়ে বন্ধু প্রথাবিরোধী সাহিত্যকর্মী, কবি, গবেষক, ঔপন্যাসিক ও শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের কথা। এ বইমেলা তার অকাল প্রয়াণে ধর্মান্ধদের যেমন ঘৃণা করতে শিখিয়েছে, তেমনি আপসহীন লেখকের চিরজয়ী হওয়ার পথ দেখিয়েছে। বইমেলাটি তার অভাবনীয় চিরবিদায়ে যেমন একটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে তেমনি তিনি ও তার মৃত্যু এর ভেতর দিয়ে শিল্পের চিরঞ্জীব অবদানে অমূল্যতার সন্ধান দিয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর